ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

অভ্যুত্থানের নগরে ডাকাত আতঙ্ক

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
অভ্যুত্থানের নগরে ডাকাত আতঙ্ক

ঢাকা: ২০২৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে আলোচিত একটি বছর। নানা কারণেই বিদায়ী বছরটি মনে রাখবে জাতি।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পালিয়ে ভারতে চলে যান তিনি। অভ্যুত্থানের পরপরই দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসন ভেঙে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে ডাকাত আতঙ্ক। বিভিন্ন স্থানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

অভ্যুত্থানের পরপর দেশের থানাগুলোয় পুলিশের উপস্থিতি ছিল না। থানায় তালা দিয়ে পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতিতে চলে যায়। এ সুযোগে দেশে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। দুর্বৃত্তরা যে যার মতো বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানগুলোয় হামলা চালায়, লুটপাট-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি অশান্ত করতে, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে গভীর রাতে পরিকল্পিতভাবে ডাকাতির আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ চলে। এ কাজে ভাড়ায় নেওয়া হয় বস্তির শিশু-কিশোরদের। সরকার পতনের দিন থেকেই রাত গভীর হলে আতঙ্ক বাড়ে রাজধানীবাসীর মাঝে।

শুধু ঢাকায় নয়; জেলায়-উপজেলায়ও রাত হলে ডাকাতির খবর পাওয়া যায়। মসজিদে মাইকিং করে ডাকাতের বিষয়ে সচেতন করা হয়। স্থানীয়রা লাঠিসোঁটা নিয়ে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন, নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন, খোঁজ দিলেই টহলরত সেনা সদস্যরা ডাকাতদের আটক করছেন— এমন খবর মুহূর্তে মুহূর্তে আসছিল।

সেদিন ৭ আগস্ট। রাত ১২টার পর থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির চেষ্টা, বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি হয়। ওই রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আরশিনগর, আঁটিবাজার, নয়াবাজার, বসিলা, বসিলা মেট্রো হাউজিং, মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিং, শেখের টেক, জিগাতলা, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ এলাকা, শনির আখড়া, মিরপুরের পল্লবী, মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর এলাকা, উত্তরা ৮-৯, ১০-১১ নম্বর সেক্টর, গাজীপুর ও টঙ্গী কলেজ রোড এলাকায় ডাকাতি হয়।

তখন এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে ২৯ জনকে আটক করা হয়। মিরপুর পল্লবী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হন ১৭ জন। আটক হওয়া কয়েকজন এলাকাবাসীর জিজ্ঞাসাবাদে জানান, নাহিদ নামে স্থানীয় এক তরুণ তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে নামিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০০ কিশোর-তরুণ সংগ্রহ করে এ কাজে ব্যবহার করছেন।

ওই নাহিদ একজন ছিনতাইকারী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের এ কাজে নামান বলেও জানান আটকদের অনেকে। বসিলা এলাকা থেকে চারজন ও মিরপুর থেকে ১৭ জনকে এলাকাবাসী আটক করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচজনকে অস্ত্রসহ আটক করে এলাকাবাসী। পরে তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। উত্তরা এলাকায়ও কয়েকজনকে আটক করে এলাকাবাসী।

৮ আগস্ট থেকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাত-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যরাতে একাধিক আবাসিক এলাকার মসজিদ থেকে সতর্কতা জানিয়ে মাইকিং করা হয়। প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে আসেন বাসিন্দারা। তখন সন্ধ্যার পর ছিনতাই, চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।

মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান ও চন্দ্রিমা উদ্যান দুটি পাশাপাশি আবাসিক এলাকা। ওই সময় রাতভর ডাকাতির আতঙ্ক চলে সেখানে। এ ছাড়া মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড, নবোদয় হাউজিংসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়ও ছিল ছিনতাই, ডাকাতির আতঙ্ক। আতঙ্কের রাতে সেনাবাহিনীর একটি দল মোহাম্মদপুরে টহল দেয়।

ঢাকা উদ্যান কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, একটি দল চাপাতি, রামদা নিয়ে সন্ধ্যার পর ঘুরে বেড়ায়। মসজিদের পাশের রেস্তোরাঁয় হামলা হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা, মুঠোফোন ছিনতাই করেছে তারা। তারা বিভিন্ন বাসায় হামলা, ভাঙচুর চালায়।

মোহাম্মদপুর, শ্যামলী হাউজিং প্রকল্প-২ আবাসিক এলাকায় স্থানীয় মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজি জামালের বাড়ি লুট হয়। তার খামারে ১২০টি গরু ছিল, যা ডাকাতেরা নিয়ে যায়।  

গত অক্টোবরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে ডাকাতির ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত পাঁচ সদস্য।

১১ অক্টোবর রাত সাড়ে ৩টার দিকে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ের কাছে সেনাবাহিনী ও র‍্যাবের পোশাক পরে ডাকাতদলের সদস্যরা একটি বাসায় ঢুকে পড়ে। সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল।

ভুক্তভোগী আবু বকর জানান, বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেওয়া হয়নি। অস্ত্র নিতে হবে— এমন অজুহাতে তারা বাসায় ঢুকে পড়ে। কোনো কথা না শুনে অস্ত্র খোঁজার নাম করে আলমারি খুলে তছনছ করে এবং টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, পরে তারা ফ্ল্যাটের একপাশে আমার অফিসে যায়। একইভাবে অস্ত্র আছে বলে সিন্দুক ও আলমারি খুলে টাকা নিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যায়। তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে ভোর সোয়া ৪টার দিকে বের হয়ে যায়। দুটি মাইক্রোবাস ও দুটি প্রাইভেট কার নিয়ে বাসার ভেতরে ২৫ থেকে ৩০ জন প্রবেশ করে, বাইরেও তাদের লোকজন ছিল।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডিএমপিতে যোগ দেওয়া ৯০ শতাংশ সদস্যরই কর্মস্থল দীর্ঘদিন ছিল ঢাকার বাইরে। তারা তখন চেনেন না রাজধানীর অলিগলি। আর রাস্তাঘাট তেমনটা না চেনায় আসমি ধরা বা মামলার তদন্তের কাজে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় থানা পুলিশের সদস্যদের।

ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তখন বলছিলেন, পূর্ণ জনবল বুঝে পায়নি ঢাকার থানাগুলো। সর্বস্তরে যাদের বদলি করে আনা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ঢাকায় একেবারে নতুন। একদিকে কম জনবল, অন্যদিকে ঢাকার বাস্তবতায় অনভিজ্ঞ পুলিশ সদস্যদের দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।

সবশেষ গত ১৯ ডিসেম্বর দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার রূপালী ব্যাংকে ডাকাতির উদ্দেশ্যে তিনজন প্রবেশ করেন। মসজিদের মাইক থেকে ডাকাতির বিষয়ে জানানো হলে আশপাশের কয়েকশ লোক ব্যাংকের ওই শাখা ঘেরাও করেন। এরপর পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র‍্যাব এসে উপস্থিত হয়। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে যৌথবাহিনীর ডাকে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করে তিন ডাকাত।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জিম্মি রাখার পর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, অস্ত্রসহ তিনজন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পরে তাদের কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় পাঠানো হয়।

তখন ব্যাংকের ভেতরে কর্মকর্তাসহ ১০ থেকে ১২ জন স্টাফ জিম্মি ছিলেন। অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা তখন ডাকাতদের সঙ্গে ‘সমঝোতা’র জন্য চেষ্টা চালান। এমন পরিস্থিতিতে জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের ‘সেফ এক্সিট’ বা নিরাপদ প্রস্থান দাবি করে ডাকাতরা। পরে শেষে আত্মসমর্পণ করে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
এমএমআই

 
 

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।