ঢাকা: ২০১৩ সালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো যুদ্ধপরাধীদের বিচার। এ বছর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিচার।
গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল মানবতাবিরোধীদের বিচার। আর এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেই তরুণ নতুন ভোটারদের সমর্থন পেয়ে যায় দলটির নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
নির্বচনী প্রতিশ্রুতিতেই ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। তিন বছর ৯ মাসের মাথায় এসে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয় বিদায়ী বছরের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা এক মিনিটে। আর এর মাধ্যমেই মানবতাবিরোধীদের প্রথম রায় কার্যকর হয়, সূচিত হয় কলঙ্কমুক্তির প্রথম ধাপের। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কসাই কাদেরের বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্নের পরাজয় হয়। জয় রচিত হয় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও তাদের স্বজন এবং বাংলার আপামর মুক্তিকামী মানুষের।
তবে আপিল বিভাগের দেওয়া কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। আর তখনই জেগে ওঠে বাংলার তরুণ সমাজ। শাহবাগে গঠিত হয় গণজাগরণ মঞ্চ। গণজাগরণ চত্বরে শুরু হয় কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিতে গণআন্দোলন।
সেখানকার গণঅবস্থানে দিনে দিনে যোগ হয় শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত। সব বয়সের সর্বশ্রেণীর মানুষের একটাই দাবি ছিল, কাদের মোল্লার ফাঁসি। ফাঁসির দাবি নিয়ে দিনের পর দিন অবস্থান করে লাখো জনতা। এ গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। জেলা-উপজেলায়, এমনকি দেশের বাইরেও শাহবাগের আদলে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি পালিত হতে থাকে।
এ গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে সংশোধিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩। সংযোজন করা হয় রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার বিধান। এরপর আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে দেন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়।
১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তান আবার মাথচাড়া দিয়ে ওঠে। পাকিস্তান পার্লামেন্টে এর নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়। পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহেদী হাশমি কোরাইশিকে তলব করে সরকার। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানকে নাক গলানোর জন্য বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করার আহবান জানায় সেই গণজাগরণ মঞ্চ।
গত বছর মোট নয়টি মামলার রায় হয়েছে দু’টি ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়টি আসে ২১ জানুয়ারি আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে। যদিও তিনি পলাতক আছেন। অপরদিকে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে আছেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক হত্যার প্রধান দুই আসামি চৌধুরী মইনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান। তাদেরকেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ নভেম্বর তাদের ফাঁসির রায় ঘোষিত হলেও সরকার তাদের ফিরিয়ে আনতে খুব কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনি বলেই ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানকে দেন মৃত্যুদণ্ড। ১৭ জুলাই দেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায়। তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-২ জিয়াউর রহমানের সময়ের মন্ত্রী আব্দুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, তাকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো না।
তবে শারীরিক অসুস্থতা এবং বয়স বিবেচনায় যখন রাজাকারকূল শিরোমনি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পান, তখন প্রশ্ন ওঠে ট্রাইব্যুনালের মানবিক দিক বিবেচনা করে দেওয়া রায় নিয়েও। সব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য অপরাধের পরও গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া রায়ে ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর সাঈদীর রায়ের পরই সহিংস হয়ে ওঠে জামায়াত। তখনকার সহিংসতায় প্রাণ হারান ৭৭ জন। এর পরেও সাঈদীর বিপক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গোলাম মোস্তফাকে কুপিয়ে আহত করে জামায়াতিরা। পরে ঢাকায় চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান তিনি।
গত ১ অক্টোবর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
তবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের ঠিক আগের দিন দিবাগত রাতে খসড়া রায়ের কিছু অংশ অনলাইনে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আর এতে প্রশ্নের মুখে পড়ে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার বিষয়টি। আটক করা হয় ট্রাইব্যুনালের দুই জন কর্মচারীসহ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ও তার সহকারী মেহেদীকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ২ এর রায়ের মধ্যে কেবল বাচ্চু রাজাকার এবং চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের রায় ছাড়া সবগুলো রায়ই আপিল বিভাগে আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
অপরদিকে ২০১৩ সালের শেষ দিন অবসরে যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। তবে তাকে পুনরায় নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। আইন মন্ত্রনালয় সূত্র জানিয়েছে, এটিএম ফজলে কবীরকে পুনরায় নিয়োগ দানের জন্য আদেশের কপির সারসংক্ষেপ তৈরি করে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই তার পুনর্নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৪
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর