দেখা যাচ্ছে, নতুন বছর ঢুকতেই টালমাটাল ছিল ব্রিটেনের রাজনীতি। বিরোধী দল লেবার পার্টি এমনকি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিও ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিপক্ষে ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মের।
এরপর আবার মার্চে ইইউয়ের সঙ্গে দেন-দরবার করে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে খসড়া চুক্তি তিনি চূড়ান্ত করেছিলেন, সেটির প্রতি সমর্থন আদায়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিল উত্থাপন করেন টেরিজা মে। কিন্তু তাতেও সফল হতে পারেননি ব্রিটেনের ইতিহাসে দ্বিতীয় এ নারী প্রধানমন্ত্রী।
অবশেষে মে মাসে ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের ব্যাপারে নতুন পরিকল্পনা নিজের মন্ত্রিসভায় ও পার্লামেন্টে অনুমোদন পাবে না, এটা স্পষ্ট হওয়ার পর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বসেন টেরিজা মে। লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে আবেগপূর্ণ বিবৃতিতে নিজের বিদায়ের কথা ঘোষণা করেন। সংক্ষিপ্ত বিবৃতির শেষ দিকে তার গলা ভেঙে আসে। অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে চোখ।
তখন তিনি বলেছিলেন, এমপিদের বোঝাতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। দুঃখজনক হলো, আমি তাদের বোঝাতে ব্যর্থ। যুক্তরাজ্যের স্বার্থে ব্রেক্সিট বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার জন্য একজন নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজনীয়তা এখন আমার কাছে স্পষ্ট।
কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রী কী পেরেছিলেন এগোতে? জুনে টেরিজা মে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলে দেশে শুরু হয় নতুন কনজারভেটিভ নেতা নির্বাচন। অনেকে চাইলেও প্রায় দুইমাসের ভোট আনুষ্ঠানিকতা শেষে নতুন প্রধানমন্ত্রিত্ব পান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী নেতা বরিস জনসন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি ব্রেক্সিট অচলাবস্থা নিরসনে।
কমন্সে পরপর ব্যর্থ হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন বরিস জনসন। বিরোধী দল তো বটেই, ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহীরাও তাকে এগোতে দেয়নি ব্রেক্সিট প্রশ্নে। এরপর ইউরোপীয় কাউন্সিলের সময় নিয়ে তিনি নামেন ‘চুক্তিহীন ব্রেক্সিটে’।
‘নো ডিল ব্রেক্সিট’, অর্থাৎ কোনো চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনিই সামনে আনেন প্রথম। তিনি বলেন, ‘চুক্তি হোক বা না হোক ৩১ অক্টোবর ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করবে। তারিখটি যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার শেষ সময়’। অবশ্য নো ডিল ব্রেক্সিটে দেশের অর্থনীতি নিশ্চিত চরম সংকটে পড়বে, এ কথা চিন্তা করে আইনপ্রণেতারা তাকে বারবার পরাজিত করেছেন।
শেষ পর্যন্ত অনেক চড়াই-উতরাই, বাধা, সমালোচনা ও অনিশ্চয়তার পর ব্রেক্সিট চুক্তির বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছান বরিস জনসন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘দারুণ এক সমঝোতায় আমরা পৌঁছেছি। পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণও ফিরেছে’। অবশ্য তিনি জানতেন না, ব্রেক্সিট চুক্তিতেও তিনি আটকে যাবেন সরকারের কাছে।
চূড়ান্ত চুক্তি হওয়ার আগে তাতে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সে হিসেবে চুক্তি অনুমোদনে হাউস অব কমন্সে ওঠেন জনসন। যাতে তিনি একের পর এক পরাজয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েন। এমনকি ব্যর্থ হয়ে আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব আনলে তাতেও তিনি পরপর দুইবার হেরে যান। অবশ্য তিনবারের সময় নানা শর্তে এ প্রস্তাবে সাড়া পেয়েছিলেন তিনি।
এরপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১২ ডিসেম্বর ব্রিটেনের ইতিহাসে যোগ হয় আরেকটি সাধারণ নির্বাচন। জনগণের কাছে ব্রেক্সিট প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান জনসনকে তথা কনজারভেটিভ পার্টিকে এনে দেয় বিপুল ব্যবধানের ঐতিহাসিক জয়।
৬৫০টি আসনের মধ্যে কনজারভেটিভ পার্টি পায় ৩৬৫টি। আর লেবার পার্টি পায় ২০৩ আসন। এসএনপি পায় ৪৮টি। বাকিগুলো অন্যান্য দলের। এদিকে, সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ৩২৬টি আসনে জয়। কনজারভেটিভরা গতবারের চেয়ে ৪৮টি আসন বেশি পেয়েছে এবার। অন্যদিকে, লেবার পার্টি ৫৯টি আসন হারিয়েছে।
জয়ের পর জনসন বলেন, আমি একটি ‘জনগণের সরকারে’ নেতৃত্ব দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমার ওপর ভোটাররা যে আস্থা দেখিয়েছেন, তা পূরণ করব। তখন লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেন, যে ফল পেয়েছি, তা খুবই হতাশার। আমার উত্তরসূরি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব দেব। আগামী নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেব না।
১৯ ডিসেম্বর নতুন পার্লামেন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভাষণের মধ্য দিয়ে। এরপর ২০ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ বিল উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এরপর এ দিনই বাজিমাত করে বসেন। ব্রেক্সিট বিলের ওপর ভোটাভুটিতে তার প্রস্তাব ৩৫৮ ভোট পেয়ে প্রাথমিকভাবে পাস হয়। বিপক্ষে ভোট পড়ে ২৩৪টি। এখন জানুয়ারির শুরুর দিকে বিতর্ক শেষে ব্রেক্সিট চুক্তিগুলোর ওপর পার্লামেন্টে চূড়ান্ত ভোট হওয়ার কথা।
ব্রেক্সিট প্রশ্নে প্রথমবারের মতো বাজিমাত করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্রেক্সিট নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসন এবং এটা সম্পন্ন করার জন্য আমরা এখানে জড়ো হয়েছি। ব্রেক্সিট সম্পন্ন করার জন্য জনগণ ভোটের মধ্য দিয়ে যে রায় দিয়েছে, তা এক দলের বিরুদ্ধে আরেক দলের বিজয় নয়। ব্রেক্সিটের জন্য। এবার সাড়ে তিন বছরের দুঃখজনক অধ্যায় শেষ হবে। সময় এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
কেন ব্রেক্সিট নিয়ে মরিয়া ব্রিটেন?
ব্রিটিশদের নিজ দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধ মেনে চলা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ছিল। এছাড়া ব্রিটেনে অভিবাসী সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে তাদের ছিল অস্বস্তি। ইইউয়ের নিয়মানুযায়ী, কাউন্সিলের ২৮ দেশের নাগরিক ভিসা ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলাচল করতে পারে। এ হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিজের সরকারের প্রথম মেয়াদে ইইউয়ের বাইরের দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও ইউরোপীয় নাগরিকদের প্রবেশ ঠেকাতে পারেননি।
পরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, দ্বিতীয় মেয়াদে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করতে চার বছরের জন্য সুবিধা বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। এতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধানরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা সদস্য দেশের নাগরিকদের সুবিধা ভাতা দেওয়ার বৈষম্য হলে তা ইইউ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে দাবি তোলেন। আর এ কারণেই যুক্তরাজ্যের ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্ন ওঠে।
৪০ বছরের বেশি সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পর ২০১৬ সালের ২৩ জুন এ প্রশ্নে একটি গণভোট হয় ব্রিটেনে। সেখানে সেদেশের নাগরিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- ব্রিটেনের কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা উচিত, না-কি উচিত না?
৫২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে। আর থাকার পক্ষে ছিল বাকি ৪৮ শতাংশ ভোট। কিন্তু সেই ভোটের ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক্সিট হয়ে যায়নি। অনেক উত্তাপ ছাড়ানোর পর আজও প্রক্রিয়াধীন ব্রেক্সিট।
১৯৭৩ সালে ব্রিটেন ইইউতে যোগ দিয়েছিল। তখন জোটের নাম ছিল ইইসি (ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটি)।
ব্রেক্সিট কী?
‘ব্রিটিশ এক্সিট’ নামটিকে সংক্ষেপে ডাকা হচ্ছে ব্রেক্সিট নামে। এটি হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়া যাওয়ার প্রক্রিয়া।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে ২৮টি দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জোট। এই জোটের সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে। এসব দেশের নাগরিকরা জোটভুক্ত যেকোনো দেশে গিয়ে থাকতে ও কাজ করতে পারেন। কোনো ভিসা লাগে না।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯
টিএ