শুরু থেকেই কূটনৈতিকভাবে রাখাইনে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে চেষ্টা চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও মিয়ানমারের একগুয়েমির জন্য ‘কার্যত’ সফল হতে পারেনি বাংলাদেশ।
তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার কিছুটা চাপে পড়লেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের ফলাফল ‘শূন্যে’র কোটায়! কারণ এখনও শুরু করা যায়নি এ প্রক্রিয়া।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট শুরু করে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় মগরাও এতে যোগ দেয় বলে অভিযোগ করেন বাস্তুহারা রোহিঙ্গারা।
তবে দেশটির সরকারি বাহিনীর দাবি, ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা সেনা তল্লাশিচৌকিতে হামলা চালায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘নিরাপত্তা অভিযান’ শুরু করে তারা।
এ ঘটনায় নতুন করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে এখন প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বলছেন, নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে তাদের বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নিজ বাসভূমের ভিটেমাটি থেকে চিরতরে তাড়িয়ে দিতেই পরিকল্পিতভাবে নিরীহ মানুষের ওপর এসব হামলা চালানো হয়েছে।
জাতিসংঘ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ঢলকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শরণার্থী জড়ো হওয়ার ঘটনা বলে আখ্যা দিয়েছে। সংস্থাটির ভাষ্য, রাখাইনে ‘জাতিগত নিধন’ চালিয়েছে মিয়ানমার বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট কূটনীতিক সূত্র বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগে কমপক্ষে পাঁচবার রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। সর্বশেষ এ ঢল শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে।
এদিকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের মানবতা ও উদারতা বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রশংসা পেয়েছে। সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য সত্ত্বেও মাত্র চার মাসে আসা ৬ লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের নজিরবিহীন আতিথ্য বিশ্ববাসীকে অবাক করে। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবর উস্কানি দিলেও তাতে পা না দিয়ে বরং কূটনৈতিক তৎপরতায় সমাধান খুঁজে চলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কূটনীতিক তৎপরতার ফলশ্রুতিতেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কাউন্সিলে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোরালো আলোচনা হয়।
তারপরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট নয় বলে সমালোচনা আছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের কয়েকটি উন্নত দেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা। পাশাপাশি সমালোচিত হন শান্তিতে নোবেলজয়ী দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিও। তবে রোহিঙ্গা হত্যার কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার।
এদিকে আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করে মিয়ানমার। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তারা কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে বরাবরই।
এরপর ওই চুক্তির আলোকে দুই দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সফর করেন। শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও কথা বলেন উভয় দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
কয়েক দফা বৈঠকের পর একপর্যায়ে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে প্রথম দফায় ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা তাদের হস্তান্তর করা হয়।
সে অনুযায়ী চলতি বছরের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরুর কথা। তবে এখন পর্যন্ত একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের অতিরক্তি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামছু-দ্দৌজা বলেন, ওরা (মিয়ানমার) তো বলেছিলো, রোহিঙ্গাদের নেওয়া শুরু করবে। কিন্তু সেটা শুরু করেনি। সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ, অবকাঠামো নির্মাণ এরকম অনেক কিছুই এর সঙ্গে জড়িত। প্রত্যাবাসনকে নিরাপদ ও টেকসই করারও একটা ব্যাপার আছে।
এদিকে রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা নিজ গ্রামে, বসতবাটিতে ফিরতে চান। তবে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে, চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে। অনেকেই আবার বলছেন, ফেরত নিয়ে মিয়ানমার আবারও তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে। ট্রানজিট ক্যাম্পে জায়গায় রাখবে।
কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন হাফেজ উল্লাহ। ২০১৭ সালে রাখাইনে সংঘর্ষ শুরুর পরপরই মংডু ছেড়ে পালিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
রাখাইনে তিনি চালের ব্যবসা করতেন। দোতলা বাড়ি, গবাদি পশু ও ফসলি জমি-জমা সবকিছু ফেলে ওই বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন তিনি। এখন কুতুপালং ক্যাম্পে পান-বিড়ির ছোট দোকান দিয়ে কোনোরকম দিন কাটে তার। সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার সাহায্যও মিলে।
সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে হাফেজ জানান, তারা বাপ-দাদার ভিটায় ফিরতে চান। কিন্তু মিয়ানমার সরকার স্পষ্ট করে কিছু বলছে না বলেই তাদের যত সংশয়।
নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবিতে রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তিতে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে সমাবেশও করেছে রোহিঙ্গারা। সেখানে তারা ঘোষণা দেয়, নাগরিকত্ব ও হত্যা-নির্যাতনের বিচারসহ অন্যান্য দাবি না পূরণ হলে কখনই মিয়ানমারে ফিরবে না রোহিঙ্গারা।
তবে গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা একটি নতুন কূটনৈতিক অগ্রগতি। এ মামলার ফলে বিশ্বজুড়ে একটা চাপের মুখে পড়ে দেশটির সরকার।
চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর স্বৈরশাসনের অধীনে দীর্ঘদিন গৃহবন্দী থাকা অং সান সু চির উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা গণহত্যার (মানবতাবিরোধী নৃশংসতার) সারাংশ তুলে ধরেন আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু।
আইসিজের কাছে তিনি দাবি করেন, মিয়ানমার যেন রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধ করে এবং নৃশংসতার অবসান ঘটায়।
তবে ১১ ডিসেম্বর বরাবরে মতো রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বক্তব্য দেন অং সান সু চি। তিনি বলেন, তার দেশের সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হবে। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ নেই।
আদালতে গাম্বিয়ার দেওয়া বিভিন্ন তথ্যকে বিভ্রান্তিকর ও রাখাইনে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে সংঘাতের ফল হিসেবে অভিহিত করেন অং সান সু চি।
রোহিঙ্গা ফেরাতে চীন-ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা আদায়ের কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।
সর্বশেষ রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় গত ২৭ ডিসেম্বর নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষমূলক উত্তেজনা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
কূটনীতিক তৎপরতার ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন দেখার বিষয়, নতুন বছরে এই প্রক্রিয়ার জট খোলে, নাকি সরকারের তৈরি ভাসানচরেই জায়গা হয় আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর!
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৯
এমএ/এজে