ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

দুঃসময়ের মধ্যেই বছর শেষ, উত্তরণ অজানা বিএনপির

মহসিন হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
দুঃসময়ের মধ্যেই বছর শেষ, উত্তরণ অজানা বিএনপির .

ঢাকা: ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে বিএনপির দুঃসময় চলছে। সেটা ২০২০ সালেও প্রায় একই অবস্থায় ছিল।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে সবাই এটা স্বীকার করেন যে তাদের এখন দুঃসময় চলছে। তবে বিএনপি কীভাবে এই দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠবে তা কেউ বলতে পারছেন না।

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে হরতালের ডাক দেয় বিএনপি। আর ৮ ফেব্রুয়ারি ছিল চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবন্দি দিবস। এই দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে বছর শুরু করে দলটি। আর দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শোকজ নোটিশই ছিল বছরের শেষ মাসের আলোচিত বিষয়। এই আলোচনা শুধু বিএনপির অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা ডিসেম্বর মাসে ছিল রাজনীতিতে মুখরোচক আলোচনার খোরাক।

২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে প্রায় ৭ মাস বন্ধ ছিল দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম। এই সময় শুধু গরিব-অসহায় মানুষকে সহযোগিতা, মাস্ক ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি, ভার্চ্যুয়াল বৈঠক, আলোচনাসভা এবং সংবাদ সম্মেলন করে সময় কেটেছে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ছিল দলটির জন্য সুসংবাদ। সেদিন বড় ধরনের শোডাউন করে নেতাকর্মীরা দলীয় চেয়ারপারসনকে শাহবাগের বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে গুলশানের ফিরোজায় পৌঁছে দেন।

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে দলীয় নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হলেও কয়েকদিনের মধ্যে তা ম্লান হয়ে যায়। তারা যখন দেখতে পান সরকারের দেওয়া শর্ত মেনে খালেদা জিয়া কাউকে দেখা সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিচ্ছেন না। মিডিয়া কিংবা ঘরোয়াভাবেও কোনো কথা বলছেন না, তখন তারা বলতে শুরু করেন, দলীয় চেয়ারপারসন মুক্ত নন। তিনি গৃহবন্দী। তাকে মুক্তি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। খোদ দলীয় মহাসচিবের বক্তব্যও একই।

জাতীয় কাউন্সিল হয়নি 
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। তিন বছর মেয়াদি এই কমিটির মেয়াদ গত বছর শেষ হলেও ২০২০ সালেও জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি। এ বিষয়ে দলের নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য, কাউন্সিল করার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। সরকার যেখানে ছোটখাটো সভাসমাবেশই করতে দেয় না, সেখানে জাতীয় কাউন্সিল করা দুরুহ বিষয়। আর জাতীয় কাউন্সিল কবে করবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

তারেক রহমানই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান 
২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওইদিনই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। এদিকে খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সাজা উচ্চ আদালত বাড়িয়ে ১০ বছর করে। অন্য একটি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয়। মোট ১৭ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে ২৫ মার্চ মুক্তি পেয়ে নিজ বাসায় অবস্থান করলেও এখনো তারেক রহমানই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

তারেক রহমানের স্কাইপে রাজনীতি
দীর্ঘদিন থেকেই দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে লন্ডন থেকে যোগাযোগ রাখেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর দায়িত্ব পান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। তখন থেকে আরও জোরালোভাবে শুরু হয় স্কাইপে রাজনীতি, যা ২০২০ সালেও অব্যাহত ছিল। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রতিদিনিই দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্কাইপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। নানা রকমের দিক নির্দেশনা দেন। প্রতি শনিবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজের নির্দেশনা আসে লন্ডন থেকে এমনটি বলেন নেতাকর্মীরা।

পালন হয়নি খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের জন্মদিন
বিশ্বব্যাপি করোনা মহামারির কারণে এ বছর দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিন পালন হয়নি। খালেদা জিয়ার জন্মদিন ছিল ১৫ আগস্ট আর তারেক রহমানের ২০ নভেম্বর। দুটি জন্মদিনই এবার নীরবে কেটেছে। তবে দুজনের জন্মদিনেই এবার সারাদেশে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়।

জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা এ বছরও আসেনি
১৯৯৯ সালে জামায়াতকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের পর থেকেই সমালোচনার মুখোমুখি হয় বিএনপি। এ বছর নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় আসে। বছরের মধ্যবর্তী সময়ে গুজব ছড়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়া হবে। যদিও দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে একজন সদস্য স্বীকার করলেও বাকিরা অস্বীকার করেন। পরে অবশ্য বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।  

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। অপরদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত নেতারা বাংলানিউজকে বলেন, জামায়াতকে জোটে রাখবে কি রাখবে না সেটা বিএনপির বিষয়। তারা ঘোষণা দিলেই পারে।
 
২০দলীয় জোট অনেকটা নিষ্ক্রিয়
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ২০২০ সালেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। জোটের বড় শরিক বিএনপির দিকে ছোট দলগুলো তাকিয়ে থাকলেও জোটকে চাঙ্গা করার বিষয়ে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ বিষয়ে জোটের শরিক এলডিপির সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে জোট আছে কি না জানি না।

করোনা ও নানা রোগে দলের অনেক নেতাকর্মী হারায় বিএনপি
প্রতি বছরের মতো ২০২০ সালেও দলের বেশকয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ অনেক নেতাকর্মীকে হারিয়েছে বিএনপি। উল্লেখ করার মতো দলের ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাজাহান সিরাজ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ হক, বিএনপি চেয়ারপারসের উপদেষ্টা খুলনা মহাগর বিএন‌পির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপ‌তি ভাষা সৈনিক এম নূরুল ইসলাম দাদু ভাই, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল খান, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সাবেক ছাত্র নেতা শফিউল বারী বাবু, পিরোজপুর জেলা বিএনপির উপদেষ্টা সাবেক প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, পাবনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম সুজা, সাবেক এমপি এমএ হাসেম(পদত্যাগী), মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান, শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র প্রার্থী শহীদ উল্লাহ শহিদ, খুলনার চালনা পৌরসভার মেয়র প্রার্থী মো. আবুল খয়ের খান প্রমুখ।   

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এক দুঃসময় অতিক্রম করছি। দলের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালেও এটা থেমে নেই। প্রতিনিয়ত দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর সরকারি দলের নেতাকর্মীরা হামলা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করছে।

তিনি বলেন, এ বছর আমাদের একদিকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। এসব নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তৃণমূলসহ সব পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ করেছি। এখনও সেই প্রক্রিয়া চলমান। আর করোনাকালে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা সাধ্যমতো অভাবী মানুষদের সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। করোনায় আমাদের দলের বহু নেতাকর্মীকে হারিয়েছি। অনেকে এখনও করোনা আক্রান্ত আছেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এমএইচ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।