ঢাকা: করোনার ছোবলে ২০২১ সালে প্রায় চার মাস আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ ছিল। দীর্ঘ ছুটি সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি জঙ্গি মামলার রায় হয় ২০২১ সালে।
অভিজিৎ হত্যায় পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড:
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে অভিজিতকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জখম করে। আহতাবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় পরে অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
২০১৯ সালের ১৩ মার্চ আদালতে এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপর একই বছর ১ আগস্ট অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত। চলতি বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। রায়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সাইমুম, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম, আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনানকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। আর শফিউর রহমান ফারাবীকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অভিজিৎ রায় একজন বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার ছিলেন। বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের আড্ডায় অংশগ্রহণ করে ফেরার পথে আক্রমণের স্বীকার হন। নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অর্থাৎ অত্র মামলার অভিযুক্তরাসহ মূল হামলাকারীরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে। তাকে উদ্দেশ্য হলো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ করতে না পারে। অভিজিৎ হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মেজর জিয়া ও আকরাম পলাতক। সম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুই আসামির সন্ধান দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অভিজিত বাংলাদেশি বংশাদ্ভূত হলেও যুক্তরাষ্ট্রে তার নাগরিকত্ব ছিল।
দীপন হত্যায় আট আসামির মৃত্যুদণ্ড:
জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফীন দীপনকে ২০১৬ সালের ৩১ নভেম্বর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই দিনই তার স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন।
দীপন হত্যায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমান। ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মুজিবুর রহমান চার্জগঠনের মাধ্যমে আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এই মামলায় বিচার শেষে চলতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মইনুল হাসান শামীম, আব্দুর সবুর, খাইরুল ইসলাম, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, শেখ আব্দুল্লাহ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব। এর মধ্যে মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব পলাতক। কারাগারে থাকা সব আসামিই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
কোটালীপাড়ায় ৭৩ কেজি বোমা রাখায় ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড:
২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক নূর হোসেন বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
এরপর ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ঘটনার ২১ বছর পর এ বছর পর চলতি বছর ২৩ মার্চ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ১৪ আসামিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- আজিজুল হক ওরফে শাহনেওয়াজ, লোকমান, ইউসুফ ওরফে মোছহাব মোড়ল, মোছহাব হাসান ওরফে রাশু, শেখ মো. এনামুল হক, মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ, মাহমুদ আজহার ওরফে মামুনুর রশিদ, রাশেদুজ্জামান ওরফে শিমুল, তারেক, ওয়াদুদ শেখ ওরফে গাজী খান, আনিসুল ইসলাম, সারোয়ার হোসেন মিয়া, মাওলানা আমিরুল ইসলাম ওরফে জেন্নাত মুন্সী ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। আসামিদের মধ্যে আজিজুল হক, লোকমান, ইউসুফ, এনামুল হক ও মোছহাব হাসান পলাতক।
এ ঘটনায় হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-২ এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
জুলহাজ-তনয় হত্যায় ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড:
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের বাড়িতে প্রবেশ করে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত তনয় নাট্য সংগঠন লোক নাট্যদলের শিশু সংগঠন পিপলস থিয়েটারে জড়িত ছিলেন।
ওই ঘটনায় কলাবাগান থানায় জুলহাজের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১২ মে মেজর জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম। গত বছরের ১৯ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
গত ৩১ আগস্ট এই মামলায় ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান। মামলায় ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুজনকে খালাস দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ছয় আসামি হলেন চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, আকরাম হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন, মো. আরাফাত রহমান, মো. শেখ আবদুল্লাহ জোবায়ের ও আসাদুল্লাহ। আর খালাস পাওয়া দুজন হলেন সাব্বিরুল হক চৌধুরী ও মো. জুনাইদ আহমদ। তারা দুইজনই পলাতক। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে পলাতক চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২১
কেআই/এএটি