ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি-২০২১

জনপ্রতিনিধির হাতে দুই খুন, সমালোচিত ফেনী

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১
জনপ্রতিনিধির হাতে দুই খুন, সমালোচিত ফেনী

ফেনী: একই বছরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দুজন নিরীহ শ্রমজীবী মানুষ। একজনের নাম শাহজালাল অন্যজনের নাম শাহীন।

তাদের একজন ছিলেন পেশায় গরু ব্যবসায়ী, অন্যজন দোকান কর্মচারী। এদের একজনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে প্রত্যাশিত চাঁদা না দেওয়ায়, অন্যজনকে পিটিয়ে মেরা ফেলা হয়েছে পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ায়। যা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  

দুটি হত্যাকাণ্ডে যাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে, তারা দুজনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং জনপ্রতিনিধি। এ দুটি ঘটনা বছরজুড়ে ফেনীকে করেছিলো সমালোচিত।  

খুনের পেছনে যাদের নাম আসে তাদের একজন ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর আবুল কালাম, অপরজন পরশুরামের মির্জানগর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান।  

হত্যাকাণ্ডের কারণ পৃথক হলেও ঘটনার পরপরই তাদের দুজনেরই গতিপথ এক হয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে তারা দুজনেই লাপাত্তা। কেউ তাদের খোঁজ পাচ্ছে না। তৃণমূল ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভাষ্যমতে, তারা দুজনই অনুপ্রবেশকারী। উড়ে এসে জুড়ে বসে ক্ষমতা বাগিয়ে নিয়েছেন। তাদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।

মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও দুজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ক্ষমতার খড়গে। এতে সাধারণ মানুষ সন্ত্রস্ত। ভয়ে মনোভাব প্রকাশ না করলেও তাদের মনে প্রশ্ন- শাহজালাল, শাহীনের পর ক্ষমতার খড়গে যাবে কত প্রাণ? এরপরে কে? পান থেকে চুন খসলেই কার হবে এমন পরিণতি?

গত বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) পরশুরামে মির্জানগর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টো ও তার সহযোগীদের মারধরে নিহত শাহীন চৌধুরীর (৫০) পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তার ৩ সন্তান এবং পরিবারের কান্নায় শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে পরশুরাম উপজেলা জুড়ে।  

বাবার হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করে শাহীনের মেয়ে সোনিয়া বলেন, বাবা আমাদের পরিবারের ছায়া ছিলো। তারা বাবাকে হত্যা করে আমাদের পরিবারকেই শেষ করে দিয়েছে। এখন আমার ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা কিভাবে চলবে। ভুট্টো চেয়ারম্যানসহ বাবার হত্যার সঙ্গে জড়িত। সবার শাস্তি চাই।  

গত শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) বাদ মাগরিব নিজ গ্রামে জানাজা শেষে দাফন করা হয় শাহীনকে। এর আগে সকালে পরশুরাম-সুবার বাজার সড়ক অবরোধ করে শাহীন হত্যার সাথে জড়িত ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টোসহ তার সহযোগীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। তবে ঘটনার পর থেকে ভুট্টোর কোনো খোঁজ মিলছে না।

এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী ফিরোজা বেগম বাদী হয়ে চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টোকে দুই নম্বর আসামি করে তার সহযোগী আবুল হাশেমকে প্রধান আসামি এবং সদ্য সাবেক ইউপি সদস্য মো. জাহিদ হোসেনসহ ৬ জনের নামোল্লেখসহ আরও ৫-৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে পরশুরাম মডেল থানায় হত্যা মামলা করেছেন।

এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) চার জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হলেন মির্জানগর ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের মৃত আলমগীর ভূইয়ার ছেলে এনায়েত হোসেন প্রকাশ আকাশ (২২), তাজুল ইসলামের ছেলে মো. আজিম (২১), পূর্ব সাহেবনগর এলাকার আব্দুল রশিদের ছেলে আবদুর রহিম (২১), খোকা মিয়ার ছেলে মো. আরিফ (২২)।

নিহত শাহীন চৌধুরীর স্ত্রী ফিরোজা বেগম জানান, তার স্বামী শাহীন পরশুরামের বাবুল কন্ট্রাক্টরের দোকানে চাকরি করতেন। সেখান থেকে ৭ লাখ টাকার মালামাল বাকিতে কেনেন মির্জানগর ইউনিয়নের মধুগ্রামের প্রয়াত সাবেক ইউপি সদস্য বিএনপি নেতা বাবুলের ছেলে হাসেম। হাসেম চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টোর ঘনিষ্ঠজন।

বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় পরশুরাম উত্তর বাজারে হাসেমের সাথে দেখা হলে তার কাছে টাকা চাইলে হাসেম ভুট্টো চেয়ারম্যানকে ডেকে আনেন। এ সময় হাসেম, নুরুজ্জামান ভুট্টু ও তাদের সহযোগীরা আঘাত করে শাহীনকে গুরুতর আহত করে। ভুট্টো চেয়ারম্যান নিজ হাতে পিটিয়ে শাহীনকে আহত করে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। পরে আহত শাহীনকে সেখান থেকে উদ্ধার করে পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মহিন উদ্দিন জানান, হাসপাতালে আনার আগেই শাহীন মারা যান। পরশুরাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. খালেদ হোসেন জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

শুক্রবার সকালে নুরুজ্জামান ভুট্টোকে গ্রেফতারের দাবিতে পরশুরাম-সুবার বাজার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন স্থানীয় এলাকাবাসী। একইভাবে বিচার চেয়েছিল রাজপথে নেমেছিল শাহজালালের স্বজনরাও।

২৪ ডিসেম্বর (শুক্রবার) সকাল ১১টার দিকে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে স্থানীয় এলাকাবাসী গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বাজারের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে পরশুরাম মডেল থানায় ঘেরাও করে মামলার প্রধান আসামি ও ২নং আসামি ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টোকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।

এর আগে চলতি বছরের ১৫ জুলাই রাতে ট্রাকবোঝাই গরু লুটে বাধা দেওয়ায় শাহজালাল (২৬) নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পরদিন সকালে ফেনী পৌরসভার সুলতানপুর এলাকার একটি পুকুর থেকে ওই ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ছিলেন শাহজালাল কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার সাগুলি গ্রামের আবদুল জাব্বারের ছেলে। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী। এ ঘটনায় পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছিল। তবে ঘটনার ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও আবুল কালামের হদিস বের করতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে শাহীনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় মির্জানগর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান ভুট্টোকে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দলের সব পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। অনেক নেতাকে এ ঘটনায় ভুট্টোর বিচার দাবি করতে দেখা গেছে। এছাড়া বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি কামাল উদ্দিন মজুমদার বলেন, নুরুজ্জামান ভুট্টোর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, যে কোনো অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলাকারীর বিরুদ্ধে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় কঠোর। অপরাধী যেই হোক, অপরাধ প্রমাণিত হলে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৪ অক্টোবর মির্জানগর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ‘বিতর্কিত’ নুরুজ্জামান ভুট্টোকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিক্ষোভ করেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রাজধানীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে তারা ওই মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানালেও কোনো লাভ হয়নি। ফের তিনিই মনোনয়ন পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন।

খুনের মামলায় আসামি হলেও ম্যাজিকের মত যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারেন তারা। কেউ তাদের টিকিও ছুঁতে পারেন না। শাহীন হত্যা মামলার ২য় আসামি মির্জানগর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টোসহ সহযোগী বেশ কয়জন ছাত্রলীগ নেতাদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন উঠেছে।  

গত শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) ইউনিয়নের পৃথক দুইটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে তাদের ভারতে যাওয়ার কথা বলছেন স্থানীয়রা। তবে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া না গেলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের এক নেতা জানান, শুক্রবার বিকালে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ১ নম্বর ওয়ার্ডের সীমান্ত দিয়ে ৬ ছাত্রলীগ নেতা ভারতে যায়। শাহীন হত্যাকাণ্ডে এদের অনেকে জড়িত না থাকলেও চেয়ারম্যানের সহযোগী হওয়ায় ভয়ে পালিয়েছে বলেন তিনি।

একই গুঞ্জন রয়েছে পলাতক আবুল কালামকে নিয়েও। যদি তাকে ধরতে জেলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তবে এখন পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে কামাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১
এসএইচডি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।