যথাযথ সংস্কার ও পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমির দগদগে স্মৃতি। নতুন প্রজন্মের সিংহভাগই জানে না এসব বধ্যভূমির ইতিহাস।
রামমালা বধ্যভূমি
৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক-হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ করে তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপরই হানাদার বাহিনী সার্ভে ইনস্টিটিউটের চারপাশ ঘিরে ব্রাশফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ ও আনসার সদস্যদের হত্যা করে গণকবর রচনা করে যায়। স্থানীয় সূত্রমতে এই বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫শ’ লোকের সমাধি।
জগতপুর গণকবর
সদর দক্ষিণ উপজেলার জগতপুর গণকবরের লাশের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি এখনও। যাত্রীবাহী বাসে হামলার ঘটনায় নিহত ওইসব নাম-পরিচয় বিহীন মরদেহ নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কারও কারও মতে ওই বাসে রাজাকাররা পালাচ্ছিল। আবার অনেকের দাবি বাসে ব্যবসায়ীসহ মুক্তিকামী মানুষ ছিলেন। সব মিলিয়ে বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত ইস্যু।
স্থানীয় একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ভুশ্চি থেকে উৎসব পদুয়া ও হরিশ্চর হয়ে লাকসাম যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে মিত্রবাহিনীর কাছে খবর আসে, লাকসাম থেকে বাসযোগে রাজাকাররা কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ বাসটিকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করে মিত্রবাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে বাসে থাকা সকল যাত্রী মারা যায়। মৃতদের গর্ত খুঁড়ে গণকবর দেওয়া হয় এখানে।
বেলতলী বধ্যভূমি
একাত্তরে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে দক্ষিণে বেলতলীর বধ্যভূমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ মাটি চাপা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদাররা লাকসাম রেলওয়ে জংশনের থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ঘাঁটি করে। ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যার পর ৫শ’ গজ দূরে বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিতো হানাদার বাহিনী।
দেবিদ্বার বধ্যভূমি
৭১ সালের ২৪ জুলাই পাকিস্তানি হায়েনারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৪২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ২৩ জন নিরীহ বাঙালিকে দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিতে ধরে আনে হানাদার বাহিনী। পথিমধ্যে ৩ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাকি ২০ জনকে চোখ বেঁধে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে গর্ত খুঁড়ে এখানে মাটি চাপা দেয়।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি
নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশেপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করে নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমির তিনটি কবরে সমাহিত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
এলাকার নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম ভূঁইয়া বলেন, ভাদ্র মাসের ১৫/১৬ তারিখের ভোর বেলায় পাক-হানাদার বাহিনী এখানে ৩টি কবর খুঁড়ে অনেককে গণকবর দেয়। এ বধ্যভূমিতে কতজনের লাশ সমাহিত হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।
চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা নামক স্থানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীরযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। বেতিয়ারার শহীদদের কবরটি এখন আগের জায়গায় নেই। মহাসড়কের চার লেনের কাজ হওয়ায় বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের কাছে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও দুর্বিষহ স্মৃতির কথা অজানা রয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সাইফ জানান, প্রত্যেকটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে এর ইতিহাস ফলকে লিখে দিলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, কুমিল্লায় প্রায় ৩০টির মতো বধ্যভূমি চিহ্নিত করে ফলক উন্মোচন করেছি। চেষ্টা করছি বাকি বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস টিকিয়ে রাখার।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
এমজেএফ