ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

খেলা

ফিরে দেখা ২০১৪

উত্তেজনায় ঠাসা বিশ্বফুটবলের এক বছর

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৪
উত্তেজনায় ঠাসা বিশ্বফুটবলের এক বছর ছবি: সংগৃহীত

চলে যাচ্ছে আরো একটি বছর। হাসি-কান্নার মাঝেই স্মৃতির খাতায় লেখা রয়েছে অনেক ঘটনা।

বিশ্বফুটবলও তার ব্যতিক্রম নয়। সময়ের ডানায় ভর করে আমরা চলে এসেছি ২০১৪ সালের শেষ পর্যায়ে। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিশ্ব ফুটবলের আলোচিত সব ঘটনাগুলো।

ব্রাজিল বিশ্বকাপঃ ব্যবসায়, দর্শক, পরিসংখ্যান আর দর্শক প্রিয়তার বিবেচনায় ইতিহাসের অনন্য স্থান দখল করে নেয় ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ।

বছরের মাঝামাঝি সময়ে আয়োজিত হয় ফুটবলের বিশ্বমঞ্চ ‘ফিফা বিশ্বকাপ’। এটি ছিল বিশ্বকাপের ২০তম আসর। আর এ আসরটি বসেছিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতা দেশ ব্রাজিলে। ২০১৪ সালের ১২ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতা চলে।

১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের পর এ আসরটি ব্রাজিলে আয়োজিত দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ছিল। এই বিশ্বকাপেই ব্রাজিল প্রতি আট বছর পর পর ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রচলিত ঐতিহ্য ভঙ্গ করে।

১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়া সবকয়টি দলই এ বিশ্বকাপে অংশগ্রহনের সুযোগ পায়। ৩২টি দল বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশগ্রহনের সুযোগ পায়। মোট ১২টি ভেন্যু নিয়ে আর ৬৪টি ম্যাচের মধ্য দিয়ে আসরটি সম্পন্ন হয়।

২০তম আসরের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে জার্মানি। রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে আর্জেন্টিনা। ফিলিপ লামের জার্মানি এ আসরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে মোট চারবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়।

বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা-জার্মানি মুখোমুখি হওয়ার আগে স্বাগতিক ব্রাজিলকে সেমিফাইনালে ৭-১ গোলের বড় ব্যবধানে হারায় জার্মানি। আর সেমিফাইনালের আরেক ম্যাচে আর্জেন্টিনা পেনাল্টি শুটআউটের (৪-২) মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে।

ফাইনাল ম্যাচটি নির্ধারিত সময়ে গোলশুন্য থাকার পর ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। অতিরিক্ত সময়ের (৩০ মিনিট) ১১৩তম মিনিটে জার্মানির হয়ে জয়সূচক একমাত্র গোলটি করেন মারিও গোতজে।

ব্রাজিল বিশ্বকাপের শীর্ষ গোলদাতা (৬টি) হয়ে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন কলম্বিয়ার জেমস রদ্রিগেজ। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি সেরা ফুটবলারের পুরস্কার হিসেবে জিতেছিলেন গোল্ডেন বল। আর সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার গোল্ডেন গ্লাভস পুরস্কারটি দখল করেন জার্মানির ম্যানুয়েল ন্যুয়ের। সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার উঠে ফ্রান্সের পল পগবার হাতে। বিশ্বকাপের ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ডটি জিতে নেয় কলম্বিয়া।

ফুটবল বিশ্বকাপের মাঝেও কিছু আলোচিত ঘটনা ছিল। ছিল নেদারল্যান্ডসের তারকা রবিন ফন পার্সির ‘ফ্লায়িং গোল’, ছিল উরুগুয়ের তারকা স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজের ‘কামড় কান্ড’, আরো ছিল আয়োজক দেশ ব্রাজিলের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ৭-১ গোলের হতাশা।

পার্সির ‘ফ্লায়িং গোল’: বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমেছিল স্পেন আর নেদারল্যান্ডস। সে ম্যাচে স্প্যানিসদের কাঁদিয়ে ৫-১ গোলের জয় পায় ডাচরা। আর সে ম্যাচেই অবিশ্বাস্য এক গোল করেন পার্সি। উড়ন্ত বলে হেড করে স্পেনের গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসকে ফাঁকি দিয়ে পার্সি গোলটি আদায় করে নেন।

সুয়ারেজের কামড়ঃ লুইস সুয়ারেজের মুহূর্তের জাদুতে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা বরাবরই ছিল। কিন্তু হুট করেই ব্যাখ্যাতীত কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলায় তার বদনামও রয়েছে। যার কারণে অনেক যন্ত্রণা সইতে হয়েছিল তার সাবেক ক্লাব লিভারপুলকে। বিশ্বমঞ্চে উরুগুয়ের বিপক্ষে ইতালির ম্যাচে প্রতিপক্ষের জিওর্জিও চিয়েল্লিনিকে কামড় দেন সুয়ারেজ। ফলে, আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নিষেধাজ্ঞা পান তিনি। এর আগে চেলসির ইভানোভিচকে আচমকা কামড়ে বসিয়েছিলেন তিনি।

ব্রাজিলের হতাশাঃ ফেভারিট হিসেবে খেলতে নামা ব্রাজিল বিশ্বমঞ্চের প্রথম থেকেই দারুণ গতিতে ছুটে চলে। কিন্তু সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ গোলের বড় পরাজয় নিয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে সেলেকাওরা। তবে, তার আগেই কলম্বিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমে ব্রাজিল তারকা নেইমার প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের অনিচ্ছাকৃত ধাক্কায় মেরুদন্ডের কশেরুকায় আঘাত পেয়ে বিশ্বমঞ্চ থেকে ছিটকে পড়েন।

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ: ক্লাব পর্যায়ে ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পূর্ণ আসর হচ্ছে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। এই প্রতিযোগিতায় মোট ৩২টি দল অংশগ্রহণ করে। আটটি গ্রুপে চারটি করে দল থাকে। প্রতি গ্রুপ থেকে দু’টি করে দল শেষ ষোলতে (নকআউট পর্ব) খেলে। প্রতিটি গ্রুপের তৃতীয় হওয়া দল সরাসরি ‘ইউরোপা লিগে’র শেষ ষোলতে খেলার সুযোগ পায়।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১৩-১৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন হয় রিয়াল মাদ্রিদ। পর্তুগালের লিসবনে মে মাসের ২৪ তারিখে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ঐ ম্যাচে অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদকে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়েছিল লস ব্লাঙ্কসরা। তবে ঐ ম্যাচে ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো অ্যাতলেতিকো। কিন্তু অন্তিম মুহুর্তে সার্জিও রামোসের গোলে সমতায় ফেরে রিয়াল।

রিয়ালের হয়ে চারটি গোল করেছিলেন সার্জিও রামোস(৯৩), গ্যারেথ বেল(১১০), মার্সেলো(১১৮) ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো(১২০-পেনাল্টি)। অ্যাতলেতিকোর হয়ে প্রথমার্ধের ৩৬ মিনিটে একমাত্র গোলটি করেছিলেন দিয়েগো গোদিন। ম্যাচ সেরা পুরস্কার জিতেছিলেন রিয়ালের আর্জেন্টাইন তারকা মিডফিল্ডার অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ৫৯তম এই আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন রিয়ালের পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তিনি ১৭ গোল করে চ্যাম্পিয়নস লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড গড়েন। এর আগে ১৪ গোল করে যৌথভাবে শীর্ষে ছিলেন বার্সার লিওনেল মেসি ও জুভেন্টাসের সাবেক স্ট্রাইকার জোসে আল্টাফিনি।

এদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১৪-১৫ মৌসুমের গ্রুপ পর্বের খেলা শেষ হয়েছে। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে গ্রুপ পর্বের খেলা শুরু হয়েছিল। শেষ হয়েছে ডিসেম্বরের ৯ তারিখে। আর শেষ ষোলোর (নক আউট পর্ব) ড্র অনুষ্ঠিত হয় ১৫ তারিখে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ থেকে নকআউট পর্বের খেলা শুরু হবে। জুন মাসের ৬ তারিখে জামার্নির বার্লিনে অবস্থিত অলিম্পিয়াস্তাদিও স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।

২০১৪ সালে মেসি-রোনালদোর অর্জনঃ

লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দু’জনই যে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতি বছরই নিজেদের ছাড়িয়ে যান মেসি-রোনালদো। দু’জনই বর্তমানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেন। মেসি যেমন বার্সার প্রাণভোমরা ঠিক তেমনি রোনালদোও রিয়ালের মধ্যমনি হয়ে আছেন।

২০১৪ সালটা মেসি ও রোনালদো উভয়ের জন্যই দারুণ কেটেছে। সেই সঙ্গে হতাশাও দু’জনকে গ্রাস করেছে। মেসি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যেতে রাখেন অনবদ্য ভূমিকা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জার্মানির কাছে হেরে গিয়ে রানারআপ হয় আলবেসিলেস্তেরা। পরে অবশ্য বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল পুরস্কার উঠে মেসির হাতে।

অপরদিকে, রোনালদোর পর্তুগাল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। কিন্তু ক্লাব পযার্য়ে রিয়ালের হয়ে ঠিকই গোল করার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন এই পর্তুগিজ। এ বছর রিয়ালের লা ডেসিমা (দশম চ্যাম্পিয়নস লিগ) জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন দুইবারের বিশ্বসেরা এই ফুটবলার। এছাড়াও রিয়ালকে কোপা দেল রে, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ ও ফিফা  ক্লাব বিশ্বকাপ জেতাতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

এ বছর জাতীয় দলের পাশাপাশি ক্লাব পর্যায়েও উজ্জ্বল ছিলেন মেসি। বিশ্ব ফুটবলের এই আইকন ফুটবলার বার্সার হয়ে প্রতিনিয়তই রেকর্ড গড়ে যাচ্ছেন। এ বছরই ভেঙেছেন বার্সার হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড। সেই সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও এখন এই ক্ষুদে জাদুকর। লা-লিগায় মেসির বর্তমান গোলসংখ্যা ২৫৮টি এবং চ্যাম্পিয়নস লিগে ৭৬টি। এর আগে লা-লিগায় এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন যথাক্রমে তেমো জারা (২৫১) এবং রাউল গঞ্জালেস (৭১)।

এ বছরের প্রথম ম্যাচে সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন রোনালদো। সেই ম্যাচে জোড়া গোল করে ক্লাব ও দেশের হয়ে ৪০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন ‘সি আর সেভেন’ খ্যাত এই তারকা। চারশ গোল করতে তিনি খেলেছেন ৬৫৩ ম্যাচ।

অপরদিকে ‘কোপা দেল রে’ তে গেটাফের বিপক্ষে এ বছরে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মেসি। সেই ম্যাচে জোড়া গোল করেছিলেন চারবারের বিশ্বসেরা এই ফুটবলার। এর আগে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির কারণে গত বছরের নভেম্বর থেকে ছিলেন মাঠের বাইরে।

বছরের প্রথমেই সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অনুষ্ঠিত ব্যালন ডি’অরের পুরস্কার বিতরণীতে মেসিকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতে নেয় রোনালদো। এর আগে টানা চারবার এই পুরস্কার জিতেছিলেন মেসি।

ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে এ বছর মেসির তুলনায় রোনালদো অনেক গুন এগিয়ে। বিশ্বকাপের ‘গোল্ডেন বল’ অ্যাওয়ার্ড ছাড়া মেসির হাতে ‍আর কোনো পুরস্কার উঠেনি। কিন্তু রোনালদোর হাতে অনেক পুরস্কার উঠেছে। ব্যক্তিগত অর্জনে রোনলদো ছিলেন উজ্জ্বল।

রোনালদোর পাওয়া অ্যাওয়ার্ড গুলোর মধ্যে রয়েছে উয়েফা বর্ষসেরা ফুটবলার, ইউরোপিয়ান গোল্ডেন ‘সু’ , লা লিগার সেরা ফুটবলার, লা লিগার সেরা স্ট্রাইকার, ডি স্টেফানো অ্যাওয়ার্ড, লা লিগা পিচিচি অ্যাওয়ার্ড, গোল ফিফটি অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’ এর চোখে এ বছরের সেরা ফুটবলার হয়েছেন রোনালদো।

এদিকে এ বছর ক্লাব ও দেশের হয়ে গোল করার ক্ষেত্রে মেসি-রোনালদো দু’জনই প্রায় সমানে সমান। মেসি ৬৬ ম্যাচ খেলে ৫৮টি গোল করার পাশাপাশি ২১টি গোলে সহায়তা করেছেন। আর রোনালদো ৬০ ম্যাচ খেলে করেছেন ৬১ গোল। সেই সঙ্গে ২২টি গোলে সহায়তা করেছেন। মেসির করা ৫৮টি গোলের মধ্যে ৫০টি এসেছে ক্লাবের হয়ে এবং বাকি আটটি দেশের হয়ে। আর রোনালদোর করা ৬১টি গোলের মধ্যে ৫৬টি ক্লাবের হয়ে এবং পাঁচটি দেশের হয়ে।

বাংলাদেশ সময়:০১০৯ ঘণ্টা, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।