ঢাকা: ইউরোপ সেরার লড়াই উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল যুদ্ধে জার্মানির বার্লিনে মাঠে নেমেছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনা এবং ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাস। নিজেদের ‘ট্রেবল জয়ের’ এ ম্যাচে সমানে সমান লড়াই হলেও শেষ পর্যন্ত জয় পেয়েছে বার্সেলোনা।
বার্সেলোনার কোচ লুইস এনরিক শুরুর একাদশে মাঠে পাঠান টার স্টেগেন, দানি আলভেজ, জেরার্ড পিকে, মাসচেরানো, জরদি আলবা, বাসকুয়েটস, ইভান রেকিটিচ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ আর নেইমারকে। ৪-৩-৩ ফরমেশনে এনরিক তার শিষ্যদের খেলাতে থাকেন।
এদিকে, জুভি কোচ ম্যাসিমিলানো আল্লেগ্রি তার শিষ্যদের শুরুর একাদশে ৪-৪-২ ফরমেশনে খেলাতে থাকেন। শুরুর একাদশে সিরি’আ জয়ীদের হয়ে মাঠে নামেন বুফন, লিস্টসটেনিয়ার, বারগাজলি, বনুচ্চি, এভরা, আন্দ্রে পিরলো, মারচিশিও, পল পগবা, ভিদাল, কার্লোস তেভেজ এবং মোরাতা।
ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই লিড নেয় কাতালানরা। জুভিদের ডি-বক্সে বাড়ানো বল পান বার্সা দলপতি আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। কাতালান অধিনায়ক বল বাড়িয়ে দেন ইভার রেকিটিচের দিকে। আর তা থেকে গোল করতে ভুল করেন নি রেকিটিচ। ফলে, ১-০তে এগিয়ে যায় কোপা দেল রে’র শিরোপাধারীরা।
খেলার অষ্টম ও ১৩তম মিনিটে জ্বলে উঠতে দেখা যায় নেইমারকে। ব্রাজিল অধিনায়কের দুটি জোরালো শট ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে একটি শট কোনাকুনি নিলে জুভি গোলরক্ষক বুফনের হাতের নাগালের বাইরে দিয়ে মাঠের বাইরে চলে যায়। মেসির বাড়ানো বলে পা ছোঁয়াতে পারলেও হয়তো নেইমার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এ আসরে দশম গোলের দেখা পেতে পারতেন। তবে, এটিও ব্যর্থ হয়।
দুই মিনিট পরেই খেলার ১৫তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুন করার সুযোগ পায় বার্সা। দানি আলভেজের শক্তিশালী শটটি রুখে দেন জুভিদের গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী বুফন। আলভেজের শটটি ডিফেন্স চেরা হলেও দারুণ দক্ষতায় ঝাঁপিয়ে পরে কাতালানদের দ্বিতীয় সাফল্য বঞ্চিত করেন বুফন।
২০ ও ২৪ মিনিটের মাথায় জুভিরা বার্সার ডি-বক্সে আক্রমণ শানে। অতিরিক্ত চাপ নিয়ে খেলা জুভেন্টাসের দুই তারকা পগবা আর মোরাতার দুটি শটই গোলবারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ম্যাচের যখন ২৬ মিনিট তখন আবারো মেসি বল বাড়িয়ে দেন নেইমারকে। তবে, সেলেকাওদের সেরা স্ট্রাইকারের শটটি এতই দুর্বল ছিল যে জুভি গোলরক্ষক বুফন তা অনায়াসে গ্লাভসবন্দি করেন।
৩৯ মিনিটের মাথায় লিভারপুল থেকে বার্সায় নাম লেখানো উরুগুয়ের তারকা সুয়ারেজ দারুণ একটি শট নিয়েছিলেন। তার শটটি বুফন ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরতে না পারলেও গোলবারের অল্প বাইরে দিয়ে চলে যায় বল। ফিরতি মিনিটে আবারো সুয়ারেজের জোরালো শট। এবারো মাথায় হাত দিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে হয় উরুগুয়ের তারকাকে। কারণ সেই বুফন। বিশ্বের অন্যতম সেরা এ গোলরক্ষক একের পর এক শট রুখে এগিয়ে থাকা বার্সাকেই যেন হুমকি দিতে শুরু করেন।
প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে বার্সার শিবিরে সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে জুভিরা। পরপর দুটি শট নিলেও কাতালানদের ডিফেন্সে প্রথমটি আর পরেরটি টার স্টেগেনের গ্লাভসবন্দি হয়। ফলে, ১-০ তে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় স্প্যানিশ লা লিগার শিরোপাধারীরা।
বিরতির আগে পর্যন্ত বার্সার দখলে বল ছিল ৬৮ শতাংশ। বাকি ৩২ শতাংশ বল দখলে রাখে জুভিরা। কাতালানদের ৩৫৮ পাসের বিপরীতে জুণ্টোসের পাসের সংখ্যা ছিল ১৬১টি। যেখানে প্রথমার্ধে খেলে বার্সার পাসিং সাফল্য ৯১ শতাংশ আর জুভিদের সাফল্য ৮০ শতাংশ।
বিরতির পর ম্যাচ শুরু হতে না হতেই আক্রমণে যায় জুভেন্টাস। পাল্টা আক্রমণে ম্যাচের ৪৭ মিনিটের মাথায় প্রায় মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে জুভিদের ডি-বক্সে প্রবেশ করেন রেকিটিচ। সুযোগ বুঝে সুয়ারেজকে বল বাড়িয়ে দেন। দারুণ শটে গোলবারে বল পাঠান লিভারপুলের সাবেক তারকা। বুফনের কারণে এবারো মাথায় হাত দিতে দেখা যায় সুয়ারেজকে। পরের মিনিটে বল পেয়ে আবারো জাল লক্ষ্য করে বলে শট নেন সুয়ারেজ। কিন্তু গোলবারের উপর দিয়ে চলে যাবে জেনে বুফন কোনো চেষ্টাই করেননি।
ম্যাচে যখন সুয়ারেজ আর বুফনের মধ্যে লড়াই চলছিল ঠিক তখন সমতায় ফেরে জুভেন্টাস। ইতালিয়ান জায়ান্টদের সমতায় ফেরান ফাইনালের আগে যিনি বলেছিলেন, ‘ফাইনালে বার্সাকে ভয় করি না’ সেই মোরাতা। ম্যাচের ৫৫তম মিনিটে মারচিশিও বাড়ানো বল পান তেভেজ। আর্জেন্টাইন এ তারকা শট নিলেও বার্সার গোলরক্ষক টার স্টেগেন প্রতিহত করেন। তবে, ফিরতি বলটি জালে পাঠান বার্সার ডি-বক্সে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা মোরাতা।
৬৩ মিনিটে তেভেজের একটি শট গোলবারের উপর দিয়ে চলে যায় আর একই মিনিটে ইনিয়েস্তার বুদ্ধিদীপ্ত একটি পাসে সুয়ারেজ পা ছোঁয়ানোর আগেই বুফনের আয়ত্বে চলে যায় বল।
বার্সার বিশ্বসেরা আক্রমণত্রয়ী একসঙ্গে জ্বলে উঠলে প্রতিপক্ষ দলের কী হতে পারে তা ফুটবল বিশ্ব দেখেছে অনেকবার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ম্যাচের ৬৮ মিনিটের মাথায় বিশ্বফুটবল আরেকবার দেখার সুযোগ পেয়েছে। মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে আসা আর্জেন্টাইন অধিনায়ক মেসি জুভিদের জালে শট নিলে আবারো বুফন জাদু। জুভিদের নির্ভরতার প্রতিক বুফন ঝাঁপিয়ে পড়ে বল রুখে দিলেও ফিরতি বলে শট নেন সুয়ারেজ। জালে বল জড়ালে ২-১ গোলে লিড নেয় বার্সা।
চার মিনিট পরেই ৩-১ ব্যবধান করে ফেলে কাতালানরা। নেইমারের দারুণ এক হেড এবার প্রতিহত করতে পারেন নি বুফন। তবে, ম্যাচের দায়িত্বে থাকা তুরস্কের রেফারি তৌকির চাকিরের চোখ এড়াতে পারেন নি নেইমার। ব্রাজিল অধিনায়কের করা হেড থেকে জালে বল জড়ানোর আগে হাতে লাগে। হ্যান্ডবলের নির্দেশ দেন রেফারি এবং লাইন্সম্যান। ফলে, ম্যাচের ফল থাকে ২-১।
৭৮ মিনিটের মাথায় বার্সার নিয়মিত অধিনায়ক ইনিয়েস্তা মাঠ থেকে উঠে যান। ম্যাচের দায়িত্ব দেন তার বদলি হিসেবে মাঠে নামা জাভিকে। আর এ ম্যাচের মধ্য দিয়েই কাতালান ক্লাবটির সঙ্গে দীর্ঘ ২৪ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করতে যান জাভি। মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার আগে জাভির হাতে শেষবারের মতো অধিনায়কত্বের ব্যান্ড পড়িয়ে দেন ইনিয়েস্তা।
ম্যাচের ৮৮ মিনিটের মাথায় সমতায় ফেরার সুযোগ পেয়েছিল জুভিরা। মারচিশিওর শট রুখে দেন টার স্টেগেন। দ্বিতীয়ার্ধের অতিরিক্ত সময়ে তেভেজের একটি শটও প্রতিহত করেন বার্সার গোলরক্ষক।
রেফারি যখন ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজাবেন ঠিক তখনই গোল করে বসেন নেইমার। পেদ্রোর অ্যাসিস্টে ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে জোরালো শটে গোল করে দলকে তৃতীয় গোল পাইয়ে দেন। আর এ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আসরে নিজের দশম গোলটি করেন ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক।
ম্যাচের বাকি সময় আর কোনো গোল না হলে ট্রেবল জয় নিয়েই মৌসুম শেষ করে বার্সা। কোপা দেল রে, লা লিগা আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা নিজেদের করে নেয় মেসি, নেইমার আর সুয়ারেজরা।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৪ ঘণ্টা, ০৭ জুন ২০১৫
এমআর