ভোর প্রায় পাঁচটা বাজে। বাস নামিয়ে দিয়ে গেলো সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ডে।
একটু আলো ফুটলে বড় দারোগার হাট বাজারে গিয়ে কমলদহ ঝরনার দিকে রওয়ানা হলাম। সঙ্গে রুট ম্যাপ ছিলো। নির্বিঘ্নে পুরো ট্রেইল চষে ফেলে ঝরনার জলে স্নান করে যখন গ্রামের মেঠোপথে ফিরছি তখন দু’একজন করে পর্যটক আসছেন। এর মধ্যেই দেখি একটি ভ্যানে বিশাল বিশাল সাউন্ড বক্স নিয়ে কিছু তরুণ চলেছে। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো তারা কমলদহ ঝরনার নীচে সাউন্ড বক্স দিয়ে ডিজে পার্টি ধরনের নাচ গান করবেন। সেই দলে ছিলেন শহীদুল ইসলাম নামে এক তরুণ।
তিনি জানান, নানা উপলক্ষে তারা সেই ঝরনার কাছে সাউন্ড বক্স দিয়ে নাচ গান করেন। জিজ্ঞেস করলাম এতে পশু-পাখির সমস্যা হবে না? চাটগাঁইয়া ভাষার প্রমিত অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো ‘এগুলি একটা সমস্যা!’
এরপর চললাম খৈয়াছড়া ঝরনার দিকে। রাস্তায়ই চোখে পড়লো পর্যটকের কাফেলা। বাহারি তাদের বেশভুষা। বসে গেছে অস্থায়ী বাজার। বছর দুই আগেও এরকম অবস্থা ছিলো না। খৈয়াছড়া গ্রাম তখন ছিলো আর দশটা গ্রামের মতোই শান্ত, নিস্তরঙ্গ। ভাবলাম তাও যদি ঝরনার কল্যাণে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক লাভ হয়। কিন্তু মানুষের চোখ মুখে খানিকটা যেনো অসন্তোষের চিহ্ন। একটু এগিয়ে ব্যাপারটা টের পেলাম।
এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। ফসলের মৌসুম চলছে। কিন্তু পর্যটকের দল তার তোয়াক্কা করছো না। অনেকে ফসল মাড়িয়ে মনের আনন্দে ছুটছে। এক কৃষকের খেত থেকে শসা জাতীয় ফল না বলেই খেতে শুরু করায় কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চাষি খেকিয়ে উঠলেন। অন্তত গোটা বারো মাইক্রোবাস গ্রামের রাস্তা তোলপাড় করে পারলে পাহাড়ে উঠে যায়!
এতো মানুষ দেখে মনটা দমে গেলো। ভাবলাম যাবো কিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম গিয়েই দেখি। ভুলটা এখানেই করলাম। এরই মাঝে আরেক উৎপাত। চারপাশ থেকে হোটেল ওয়ালাদের উৎপাত। আগে যখন এসেছিলাম তখন এখানে সাধারণ বাড়িঘরও ছিলো না। জঙ্গলে জায়গা এখন জমজমাট। চিৎকার করে খাবারের অর্ডার করতে ক্রেতা ডাকাডাকি চলছে। পুরো ট্রেইলে স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটার কোনো অবস্থা নেই।
শত শত মানুষ চলাচলের ফলে সাধারণ পায়ে হাঁটার পথটি হয়ে উঠেছে পিচ্ছিল। ঝিরির পানি একেবারে ঘোলা। আরো উপরের দিকে মানুষের ঝাপাঝাপিতে পানির এ দশা। খৈয়াছড়া তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশের অন্যতম সেরা ঝরনা। এর ধাপই আছে দশের অধিক। কোনো রকমে একে অন্যের ঠেলা খেতে খেতে চলতে চলতে ভাবছি সামনের দিকে ঝরনার আর কি দুরাবস্থা দেখতে হবে। একেবারে থ বনে গেলাম ঝরনার সবশেষ স্টেপের নীচে এসে। স্বচ্ছ স্ফটিক জলে কুলকুল রবে যেখানে এসে স্বর্গের কথা মনে হওয়া উচিত, উল্টো এখন চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
পুরো জায়গাটি পানির পরিত্যক্ত বোতল দিয়ে পরিপূর্ণ। ছোট্ট এক চিলতে জায়গাটাতে অন্তত ত্রিশ পয়ত্রিশ জন মানুষ দাপাদাপি করছে। এরপর আরও উপরে ওঠার পালা। রাস্তার অবস্থা আর বলার মতো না। এতো মানুষের পায়ের চাপ সামলাতে তার কি দায় ঠেকেছে। রাস্তা ভেঙে একাকার, কাদায় থিক থিক করছে। বেরিয়ে এসেছে গাছের শেকড়। খৈয়াছড়ার মূল ধাপটিতে এসে চক্ষু চড়কগাছ। নীচে ত্রিশ পয়ত্রিশ জন ছিলো, এখানে দেখি দেড় দুশো লোক।
প্লাস্টিকের ভাগাড় হয়েছে যেন! ঝরনার নীচেই বসে গেছে দোকান। ইচ্ছেমতো এনার্জি ড্রিংক, চকলেট খেয়ে তার খোসা ফেলা হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করলো বিরিয়ানির প্যাকেটের ডাই। এসব পরিত্যক্ত প্যাকেট থেকে সুবাসের বদলে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। সঙ্গীদের বললাম আর সম্ভব না, আমি ফিরবো। মনে পড়লো আমার প্রথম খৈয়াছড়া দর্শনের কথা। সেদিন আমরা তিনজন বাদে আর কেউ ছিলো না। এ ঝরনা ভুবন মোহিনী রূপে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছিলো। সেই রূপই কি এই অসাধারণ ঝরনাধারার শেষ পর্যন্ত কাল হলো? ছিঃ আর আসবো না।
বাংলাদেশ সময়: ০২৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৬
এএ