খুলনা: অনেকেই সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন কিন্তু রাসমেলার সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি। তারা এবার ঘুরে আসতে পারেন দুবলার চরের রাসমেলা থেকে।
সুন্দরবনের পাশেই ছোট্ট দ্বীপ দুবলার চর। বঙ্গোপসাগরের বুকে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর তীরে জেগে ওঠা এ চরে দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে রাসমেলা। এটি নয়নাভিরাম একটি দ্বীপ। এখানে চিত্রল হরিণের দল ঝাঁকে ঝাঁকে চরতে দেখা যায়।
প্রতি বছর হাজার হাজার লোক রাসমেলায় অংশ নিতে আসেন। ভারত থেকেও অনেকে আসেন। এই মেলায় গ্রাম্য অনেক খাবার, মিষ্টি, সন্দেশ, অনেক রকম শুঁটকি, পুতুল নাচ, যাত্রাপালাসহ অনেক ঐতিহ্যবাহী জিনিসের সন্ধান মেলে। ১২ নভেম্বর শুরু হবে তিন দিনব্যাপী এ রাসমেলা। সমুদ্রকোলে পাঁচ মাইল প্রশস্ত বালুকাবেলায় পদব্রজে ভ্রমণ করে ক্যামেরাবন্দি করতে পারেন আশ্চর্য সুন্দর সব চিত্র।
১২ থেকে ১৪ নভেম্বর চন্দ্রিমার আলোকমালায় শোভিত নীরব চরাঞ্চল সরব হয়ে উঠবে পুণ্যার্থীদের প্রার্থনা আরাধনায়। বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম প্রধান পার্বণ রাস উৎসব, দুবলার চরের আলোর কোলে বিশেষ মাত্রায় সাড়া ফেলে বিভিন্ন মহলে। সাগর-প্রকৃতির অভাবনীয় সৌন্দর্যের মধ্যে পুণ্য অর্জন আর আনন্দ-সঞ্চার যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কবে থেকে রাসমেলা
দুবলার চরের রাসমেলার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। জানা যায়, ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এ মেলার শুরু করেছিলেন ১৯২৩ সালে। এই সাধু চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের ফল-মূল খেয়ে জীবন-যাপন করতেন।
অন্য একটি মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগের কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকে শুরু হয় রাসমেলার।
আবার কারও কারও মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ উপলক্ষেই দুবলায় পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।
কী হয় রাসমেলায়
দুবলার রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিদেশ থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী ও পর্যটকের সমাগম ঘটে। প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ প্রতি বছর এ উৎসবে অংশ নেন।
রাসমেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পুণ্যার্থীরা। তারা সাগরকে সামনে নিয়ে নির্জনে কৃষ্ণপূজার সঙ্গে দেবতা নীল কমল আর গঙ্গাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন হন। পাপমোচন করেন সমুদ্রস্নানে। সূর্যোদয়ে পর পানিতে ভাসিয়ে দেন ফল-ফুল। এরপর ঢাক-ঢোলক-কাঁসা-মন্দিরা বাজিয়ে ভজন-কীর্তনে ভরিয়ে তোলেন চারপাশ। পূজা-অর্চনার ফাঁকে সূর্যাস্তের পর সাগরকে সাক্ষী করে আকাশের বুকে উড়িয়ে দেওয়া হয় ফানুস।
সন্তানহীন ধর্মনুরাগী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দুবলার মেলায় মানত করেন এবং মেলায় এসে মানতকারীরা আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে থাকেন। মেলায় বাদ্য, নৃত্য, গীত ও বিবিধ প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। পসার সাজিয়ে বসে কুটির শিল্পের দোকান ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, মিষ্টান্ন সামগ্রীর।
যেভাবে যাবেন
নিজস্ব উদ্যোগে সুন্দরবনের গহীনে ভ্রমণ কঠিন। তাই রাসমেলা ছাড়াও সুন্দরবনে ভ্রমণে যেতে সাহায্য নিতে হবে অভিজ্ঞ কোনো ভ্রমণ সংস্থার।
এবারের রাস উৎসব উপলক্ষে সুন্দরবনে বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে অসংখ্য বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা।
দ্য ম্যানগ্রোভ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসে খুলনা-সুন্দরবন-খুলনা, তিন দিন-দুই রাতের এ ভ্রমণে জনপ্রতি খরচ হবে সাড়ে ছয় হাজার টাকা থেকে সাত হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৯১৭৭২১২৩৬, ০১৭১৬২৭৯৪০৪।
এস আর ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের তিন দিন-দুই রাতের এ ভ্রমণে জনপ্রতি খরচ হবে সাত হাজার ৫শ টাকা। যোগাযোগ: ০১৭২৫২৩২০২৩, ০১৯১৯২৯৪৪৪৪।
সুন্দরবন পলি ট্যুরিজমে জনপ্রতি খরচ হবে ছয় হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৭১৫৬৩৪৬৯৪। সাওদান ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসে জনপ্রতি খরচ হবে সাড়ে সাত হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৭১২-৭৭৩৩৬১। এ ধরনের প্রায় ২০ থেকে ২৫টি ট্যুরিস্ট কোম্পানি খুলনার বিআইডাক্লিউটিএ’র লঞ্চ ঘাট থেকে সুন্দরবনের রাসমেলায় যাবে। খুলনা থেকে লঞ্চে সুন্দরবন যাতায়াতে সবার জন্য থাকছে এসি/ননএসি কেবিন ব্যবস্থা এবং একই মানের খাবার। দুবলার চরে রাসমেলা দেখা ছাড়াও এ প্যাকেজে থাকছে হিরণপয়েন্ট, আলোরকোল, কটকা, জামতলা, টাইগারপয়েন্ট ও কচিখালী ভ্রমণের সুযোগ। এছাড়া থাকবে বনের ভেতর ট্রেকিং, বিচভলিবল, ফানুস ওড়ানো ও সাংস্কৃতিক আয়োজন।
ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে বিভিন্ন বাসে খুলনা বা মংলায় এসে নৌ পথে রাসমেলায় যেতে পারেন। খুলনায় ট্রেনে এবং যশোর পর্যন্ত বিমানেও যাওয়া যাবে। পাশাপাশি নৌপথেও আসা যায়। তবে রাসমেলায় যাবার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো খুলনার বিআইডব্লিউটিএ’র লঞ্চ ঘাট থেকে। কেননা এ লঞ্চ ঘাট থেকে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা রাসমেলা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করে থাকে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এবারের রাসমেলায় সর্বকালের সর্বাধিক কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। কোনো লঞ্চ ৭৫ জন যাত্রীর বেশি নিয়ে বনে প্রবেশ করতে পারবে না। নির্ধারিত ৮টি রুটে ভ্রমণকারীদের যাতাযাত করতে হবে। হরিণ নিধন বন্ধে ও তীর্থ ভ্রমণ যাত্রীদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশের যৌথভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
রাসমেলা উদযাপন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী কামাল উদ্দন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ১২ থেকে ১৪ নভেম্বর তারিখে দুবলার চরে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে আয়োজক কমিটি মেলা উদযাপনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৬
এমআরএম/এসএনএস