শীতকাল বলে খালের পানিতে তেমন স্রোত নেই। পাথর তুলতে তাই খোঁড়া হয়েছে গর্ত।
অথচ ভূমির গঠন, জীববৈচিত্র্য, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্পর্শকাতর পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য এসব পাহাড়ি নদী, খাল ও ঝিরির পাথর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব পাহাড়ি জলাভূমির নীচে থাকা জীববৈচিত্র্য মূলত বাঁচে পাথরের উপর নির্ভর করে। মাছ, কাঁকড়া, সাপসহ অন্যান্য কীট পতঙ্গ পাথরের আশ্রয়ে নিজেদের বাসস্থান তৈরি করে। পাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তাদের জীবন চক্র।
গাছ থাকলে যেমন পাখি থাকবে না তেমনি পাথর না থাকলে নষ্ট হবে জলের নীচের প্রাণীদের বাস্তু সংস্থান। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড.আইনুন নিশাত এর বক্তব্য, উন্নয়নের জন্য পাথরের প্রয়োজন আছে। কিন্তু কিভাবে তা তোলা হচ্ছে সেটি অনেক বড় বিষয়। নদীর তলদেশ থেকে গর্ত করে পাথর তোলা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। আর এলাকাটি যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম, তাই এখানকার জীব বৈচিত্র্যের কথাটাও ভাবতে হবে।
বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গা, বিশেষ করে বান্দরবানে পাথর উত্তোলন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। রুমা, থানচি, আলি কদম, রোয়াংছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় একেবারে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে অবৈধ পাথর উত্তোলন। রুমার রুমা খাল, মরিয়মপাড়া, চম্পাঝিরি, রুংরাং ঝিরি, গোদারঝিরি, ব্যাঙ ঝিরি, মিয়ংঝিরি, রোয়াংছড়ি উপজেলার অংতং খুমিপাড়া, ঘেরাউ, হেডম্যানঝিরি, প্রাংসা ঝিরি, কানাইজো ঝিরি, সদর উপজেলার টংকবর্তী, গেজমনিপাড়া, রেইছা, থানচি উপজেলার নাইক্ষংঝিরি, শিলা ঝিরি, তিন্দুমুখসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে অবৈধ পাথর উত্তোলনের মচ্ছব।
রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত রাস্তার কথা বলে রুমা খাল উজাড় হচ্ছে। অথচ এ প্রকল্পের সব নির্মাণ উপকরণ কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুধু হাতের নাগালে হওয়ায় এবং তহবিল তছরুপের জন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবে বিপদাপন্ন রুমা খাল উজাড় করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই অবৈধ পাথর উত্তোলনে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের বিরুদ্ধে তাই মুখ খুলতে রাজী নন স্থানীয় কেউই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ কেউ অবশ্য জানিয়েছেন, যে এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে তা গহীন অরন্য ও পাহাড়ি এলাকা। সেখানে বিভিন্ন আদীবাসি সম্প্রদায়ের বাস। এই খাল ধ্বংস হয়ে গেলে পানীয় জলের প্রকট অভাবে পড়বে তারা। কঠিন হয়ে পড়বে জীবন ধারণ।
পাথর উত্তোলনের কথা স্বীকার করে রুমা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ শরীফুল হক বলেন, মোবাইল কোর্ট করে আমরা ইতিপূর্বে জরিমানা করেছি। কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় অনেক সময় ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তারা রাতে পাথর তোলে। অনেক সময় আমরা যাওয়ার আগেই তারা পালিয়ে যায়। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোকও এর সঙ্গে জড়িত। রুমা-বগালেক রাস্তার কাজে তারা পাথর সাপ্লাই দেয়। তবে ইতিমধ্যেই ওসিকে বলেছি এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব এলাকায় মূলত নদীনালা ও ঝিরির উৎসমুখে পাথর তোলা হচ্ছে। ফলে নতুন করে শূন্যস্থান পূরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। তাই এখনই কোন ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই মারাত্মক পরিবেশগত ঝুঁকির আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহান।
তার মতে, নদী বা খালের পাড়ে গর্ত করে পাথর তুললে নদী ভাঙ্গন তরান্বিত হয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ইকোলজি অন্য এলাকা থেকে ভিন্ন। সেখানে পাথর তুলতে হলে অবশ্যই আগে পরিবেশের লাভ ক্ষতি নিরূপন করে নিতে হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এ সংক্রান্ত বিধিমালা অনুযায়ী, নদী ও এ ধরনের জলাশয় থেকে ভাসমান পাথর ছাড়া তলদেশ খুড়ে পাথর আহরনের কোন অনুমতি নেই। কিন্তু ওই নিয়মের পরোয়া করে না পাথর ব্যবসায়ীরা। তাদের লাভের নেশায় তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো জাফলং এর মতো অমোঘ নিয়তির পথেই এগুচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৭
জেডএম/এসআরএস