কেন, সেটা বেশ আগে এক পাহাড়ি বন্ধু বলেছিল, বরষার সত্যিকার রূপ দেখতে হলে তোমাকে যেতে হবে পাহাড়ে। চূড়ায় দাঁড়িয়ে একবার যদি ঝুম বৃষ্টি দেখো, বাজি ধরে বলতে পারি- সারাজীবন মনে থাকবে!
সত্যিই তাই! প্রথমবার পাহাড়ে বৃষ্টি দেখে বান্দরবানের ওই বন্ধুর কথা মনে পড়েছিল সবার আগে।
কিছু বিষয় শুধুই অনুভূতি সাপেক্ষ, ব্যাখ্যা বা বর্ণনা সাপেক্ষ নয়। পাহাড়ে বৃষ্টি দেখা এমনই। ঝুম বৃষ্টির সময়ও প্রতিটি ফোটা আলাদা আলাদা করে চোখে পড়বে। যেনো ঝরঝর করে আকাশ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি মণি-মুক্ত ঝরে পড়ছে। বৃষ্টির পড়ার প্রতিটি শব্দ অনুভূত হবে আলাদা করে। মনে হবে, ফোঁটাগুলো ঠিক চড়াই-উৎরাই পাহাড়ি জমিনে নয়, নিজের হৃদয়ের গভীরে এসে অজানা এক তাল-লয়ে সুর তুলছে।
পাহাড়ে একটি বিষয় খুব হয়, এই বৃষ্টি আছে তো এই নেই। বৃষ্টির সময় একরকম সৌন্দর্য, বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ঠিক পরে আরেকরকম। তখন নতুন করে পাহাড়ের জন্ম হয়। পাহাড়ি গাছ, লতাপাতা বৃষ্টির জলে ধুয়ে আরও সবুজ হয়ে ওঠে। যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলালে শুধু সবুজ আর সবুজ। এক কথায় বললে, সবুজের মহাসাগর আর এর একের পর এক ঢেউ মনের বালুতটে এসে আছড়ে পড়ে।
বরষার সময় বহুবার বান্দরবানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ট্রাভেলার, ট্র্যাকার ও ভ্রমণ লেখক রিয়াসাদ সানভীর। তার অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে বললেন, দুই ধরনের পর্যটকদের জন্য বরষার বান্দরবান সবচেয়ে সেরা। এক, যারা আরামপ্রিয় ও রোমান্টিক। স্রেফ রিলাক্সেশনের জন্য এই সময় একদম উপযুক্ত। দুই, যারা ঝরনা ও পাহাড়ি ঝিরি-নদীপ্রেমী। একমাত্র বরষার সময়ই ঝরনাগুলো নিজস্ব রূপে দেখা দেয়। পানির প্রবাহ বাড়ে। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।
পাশাপাশি আরেকটি বিষয়, বরষাকালে পাহাড়ি নদী ও ঝিরিগুলো জেগে ওঠে। তখন যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নদীর বুকে নৌকায় করে পাহাড় ও বৃষ্টি দেখার অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই, যোগ করেন সানভী।
‘জুমের সময় ঝুম বৃষ্টি’ বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। কারণ, বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়িদের রয়েছে আত্মিক যোগ। মার্চ-এপ্রিলের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড় প্রস্তুত করা হয়। চাষের জায়গার আগাছা ও লতাপাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলেন পাহাড়িরা। এরপর বীজতলা তৈরি। শীতের পরপর পাহাড় এমনিই একটু রুক্ষ হয়ে ওঠে, সবুজাভ ভাবটা কমে যায়। মে-জুনের দিকে বৃষ্টি ঢোকার ১০-১৫ দিনের মধ্যেই বদলে যায় পাহাড়ের রূপ। গাছ, লতাপাগা জেগে ওঠে সতেজ-সবুজ রঙে। ঝুম বৃষ্টির স্পর্শ পেয়ে বীজের জঠর থেকে ধীরে ধীরে আকাশপানে চায় জুম ধানের চারা। এরপর অপেক্ষা বৃষ্টি আর মেঘের।
সাধারণ পর্যটকরা বরষার সময়কে বান্দরবান তথা পাহাড়ে যাওয়াকে ‘অফ সিজন’ হিসেবে ধরে থাকেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো, পাহাড় ঠিক এই সময়ই স্বরূপে দেখা দেয়। একমাত্র বরষার পাহাড় যে বহুরূপে দেখা দেবে, অন্যসময় থাকে এর চার ভাগের এক ভাগ। এই সুযোগ সত্যিকার ভ্রমণ পিপাসুরা কখনই ছাড়েন না, ছাড়া উচিতও নয়।
এই সময়ে বান্দরবানের বিভিন্ন রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলগুলো থাকে বিশেষ ছাড়। যা অনেকেরই অজানা। কারণ, অনেকের বরষায় বান্দরবানের রূপ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ওই সময়টা ও পথ মাড়াতে চান না। অ্যাডভেঞ্চার ও ভ্রমণে এক-আধটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে, নয়তো দুর্লভ সব আনন্দের অভিজ্ঞতা মিলবে কী করে!
কথাপ্রসঙ্গে বান্দরবানের এনডিসি হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ বলেন, বরষায় বান্দরবান অন্যরূপে সেজে ওঠে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সময় পাহাড়গুলো আরও সুন্দর দেখায়। পরিবারসহ নীলাচল, মেঘলা, প্রান্তিক ও চিম্বুকের মতো পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরে যাওয়ার জন্য বরষা খুব ভালো সময়।
বরষায় বান্দরবানের অবস্থা দাঁড়ায় ‘এক অঙ্গে এতো রূপ’র মতো। একে তো মেঘ-বৃষ্টির অপরূপ লীলা, সেইসঙ্গে সবুজে রাঙানো পাহাড়, যৌবনবতী ঝরনা, বাঁধভাঙা পাহাড়ি নদী-ঝিরি - আর কী চাই? হ্যাঁ, চাই শুধু বান্দরবানে ছুটে যাওয়ার মতো একটি ‘ইচ্ছা’।
দূর থেকে কুণ্ডলী পাঁকানো মেঘের মতো ধেয়ে আসা বৃষ্টিতে চোখ বন্ধ করে ভিজে আসুন। বিফলে মূল্য ফেরত!
কীভাবে যাবেন
ঢাকা টু বান্দরবান সরাসরি বাস রয়েছে। রাজধানীর ফকিরাপুল ও কলাবাগান থেকে ইউনিক, সৌদিয়া, ডলফিন, এসআলম, হানিফ, শ্যামলী, সোহাগ, দেশ প্রভৃতি বাসগুলো নন-এসি ৬০০-৬৫০ ও এসি ৮৫০-৯৫০ টাকায় বান্দরবান পৌঁছায়। সময় লাগে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। ট্রেনেও যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে নেমে যেতে হবে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে বাস বা নিজস্ব ব্যবস্থায় বান্দরবান। ট্রেনভেদে ভাড়া লাগবে ৫০০-৮০০ টাকা। সময় বাঁচাতে চাইলে ঢাকা টু চট্টগ্রাম প্লেনে, সেখান থেকে বান্দরবান। প্লেনের ভাড়া ৩০০০ টাকা থেকে শুরু।
কোথায় থাকবেন
বান্দরবানে পর্যটন করপোরেশনের একটি হোটেল রয়েছে মেঘলাতে। এর ভাড়া রুম প্রতি ৭৫০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। শহরের বিভিন্ন হোটেল ও কটেজগুলোতে ৩০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে থাকা যাবে। এছাড়া সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত নীলগিরি কটেজে থাকা যাবে ৫৫০০ থেকে ৭৫০০ টাকার মধ্যে।
কোথায় ও কী খাবেন
বান্দরবানে সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত খাবারের জন্য প্রথম পছন্দ হতে পারে জেলা প্রশাসন পরিচালিত মেঘলা হোটেল। সকালের নাস্তায় জুমের চালের মুন্ডি, কলাপাতা পিঠা, পাটিসাপটাসহ নানা ধরনের পিঠা, ব্যাম্বো পিঠার পাশাপাশি থাকবে নিয়মিত পরোটা, সবজি প্রভৃতি। তবে পাহাড়ের ঐহিত্যবাহী বিভিন্ন খাবার খেতে গেলে আগে থেকে অর্ডার করতে হবে। দুপুর ও রাতে খাবারে চায়নিজ আইটেম, বাঙালি খাবার, বিভিন্ন পদের বিরিয়ানির পাশাপাশি থাকবে স্থানীয় বিভিন্ন পদ। এছাড়া পর্যটন আকর্ষণী খাবারের মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের কোঁড়ল। মেঘলা ছাড়াও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে মানসম্মত বিভিন্ন হোটেল রয়েছে। সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত খাবার মিলবে সেখানে।
কম খরচে বান্দরবান ভ্রমণ
ঢাকা থেকে যাওয়া আসা, বান্দরবানে দুই-তিন দিন থাকা-খাওয়া ও আশেপাশের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে জনপ্রতি খরচ পড়বে নূন্যতম ৩৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৭
এসএনএস
আরও পড়ুন
** ক্ষমা করো রূপমুহুরী
** সবচেয়ে উঁচু রাস্তায় হাতের মুঠোয় প্রাণ
** গিরিখাদ পেরিয়ে রহস্যময় আলীর সুড়ঙ্গে
** নীরবতা কথা কয় (ভিডিও)
** খাবারে পাহাড়ি সাজ-ঐতিহ্যের হলিডে ইন
** ৩ ঘণ্টার ট্রেইলে ঘেমে-নেয়ে কেওক্রাডংয়ের স্বর্গচূড়ায়
** নীলাচলে ভোরের আলোয় মেঘের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’
** অজগরের মাংস খেতেই জেগে উঠলো বগালেক!
** পাহাড় পেখম খোলে চিম্বুকে
** ঘুম ভাঙালো মেঘ
** টাইটানিক ও মেঘ-পাহাড়ের মিরিঞ্জা
** দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম ‘পাসিংপাড়া’
** কুমারী ঝরনা’র ঝলক!
** মাতামুহুরীর বাঁকে স্বর্গ দর্শন