ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

‘শাড়ি না কিনে প্লেনের টিকিট কিনি’

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৩
‘শাড়ি না কিনে প্লেনের টিকিট কিনি’ আসমা আজমেরী

ঢাকা: সবুজ পাসপোর্ট হাতে ১৪৩ দেশে ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশি নারী কাজী আসমা আজমেরী। বিশ্ব পর্যটক হিসেবে শতাধিক দেশে বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরার গৌরব অর্জন করেছেন তিনি।

তবে ভ্রমণের পিপাসা তার মেটেনি, ঘুরতে চান আরও, দেখতে চান বিশ্ববৈচিত্র্য।

সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে নিজের ভ্রমণের কথা শোনান এই পরিব্রাজক। তিনি জানান ১৪৩ দেশ ভ্রমণের গল্প আর এই পথে নানা অভিজ্ঞতার কথা।

ভ্রমণের শুরুর গল্পটা নিয়ে কাজী আসমা আজমেরী বলেন, থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম ২০০৭ সালে। তখনো এভাবে ভ্রমণের নেশা চাপেনি মাথায়। তবে ২০০৯ সালে প্রথমে একা একা নেপালে যাই, আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমার বিশ্ব ভ্রমণের পরিকল্পনা। একজন নারী পর্যটক হিসেবে আমার অনেক অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে।  

তিনি বলেন, প্রতিবেশী-স্বজনরা নানা কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন, একজন নারী হয়ে তুমি কীভাবে একা একা বিশ্ব ঘুরবে? মূলত এমন সব কথার কারণে আমার ভেতরে জেদ সৃষ্টি হয়। সেখান থেকেই ভ্রমণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। তখন ভাবি বিশ্ব ভ্রমণ করে আমাকে দেখাতেই হবে। এ ছাড়া, ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ছিলাম, প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল ঘুরে বেড়ানোর, বিশ্বকে দেখার। এমন মনোভাব থেকেই বিশ্ব ভ্রমণ শুরু।

নতুন একটি দেশ মানেই নতুন একটি সংস্কৃতি। এই বিষয়ে আসমা আজমেরী বলেন, যখন একটি নতুন দেশে যাই, তখন চিন্তা থাকে সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার, সেগুলো সম্পর্কে জানার। প্রতিটি দেশের রয়েছে আলাদা-আলাদা সৌন্দর্য, ভিন্ন সংস্কৃতি, যার প্রতিটিই আমাকে দোলা দিয়েছে।  

তিনি বলেন, মরক্কো ভালো লেগেছে, ইবনে বতুতার বাড়ি দেখেছি। মিশরের পিরামিড, কিউবাও খুব ভালো লেগেছে। প্রতিটি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই ছিল অন্যরকম ভালো লাগার। গাইড যদি না থাকে, তবে স্থানীয় সংস্কৃতিকে খুব সহজে বোঝা যায় না। সেদিক থেকেও স্থানীয়রা আমাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের পতাকাকে যে বিশ্বের এতগুলো দেশে পৌঁছে দিতে পেরেছি, তা শুধু আমার একার নয়,  বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জয় বলে আমি মনে করি। এই পতাকার মাধ্যমে আমার দেশ আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর মানুষের কাছে আমি শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি তাদের আমার দেশ সম্পর্কে জানাই। আর পতাকা আমার কাছে দেশপ্রেমের চিহ্ন। এই পতাকার মাঝে লুকিয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসা। আছে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো লাখো শহীদের রক্ত। তাদের কারণেই তো আমরা এই পতাকা পেয়েছি।

ভ্রমণ করতে গিয়ে কোন বাধা-বিপত্তি পোহাতে হয়েছে কি না জানতে চাইলে আসমা আজমেরী বলেন, বিশ্ব ভ্রমণ আর পর্যটক হিসেবে যেমন অনেক কিছু জেনেছি, তেমনি অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছি। তবে ভিসা প্রাপ্তি থেকে শুরু করে পদে পদে অনেক বাধা এসেছে, পোহাতে হয়েছে বিড়ম্বনা। এখনো বাংলাদেশকে অনেকে চেনে না, ভাবে ভারতের একটি অংশ। তখন আমি তাদের বোঝাই, এটি ভারতের অংশ নয়, আলাদা স্বাধীন দেশ।

তিনি বলেন, আমি ২০১০ সালে ভিয়েতনামে গিয়েছিলাম, তখন আমার রিটার্ন টিকিট, হোটেল বুকিং ছিল না। সেই সঙ্গে আমার বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্ট। সব কিছু মিলিয়ে তারা আমাকে সন্দেহ করে, ভাবে পার্মানেন্ট কোনো দেশে থেকে যাব। এই অবস্থায় আমাকে তাদের ইমিগ্রেশন ২৩ ঘণ্টা জেলে আটকে রেখেছিল। এটি ছিল আমার জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতা, আমি কান্না করেছি, খারাপ লেগেছে খুব।  

তিনি আরও বলেন, সৌদি আরবেও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তবে এমন কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দারুণ। আমি দেখেছি, অন্যান্য দেশে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, তা হলো ছেলেমেয়েদের মধ্যে সম অধিকার। ছেলেরা বাচ্চা রাখে, বাবারা বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এটি সত্যিই অনেক সুন্দর, যা আমাদের এখানে এখনো সেভাবে হয়নি।

বিশ্ব পর্যটকের পাশাপাশি একজন চেঞ্জমেকার ও মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও কাজ করছেন কাজী আসমা আজমেরী। এ বিষয়ে তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই জেন্ডার বৈষম্য বিষয়টি আমাকে তাড়িত করত। আমি রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যুক্ত আছি। বিভিন্ন দেশে স্কুল-কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানায় ছেলেমেয়েদের ভ্রমণের গল্প শোনানোর জন্য।  

তিনি বলেন, আমার ভ্রমণের ৯০তম দেশ ফিলিপাইন থেকে আমার জীবনের গল্প শোনানো এবং ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করার কাজ শুরু করি। অসমতার বিষয়ে তাদের সাহস দিই। আমি এ পর্যন্ত  ৫০ হাজার ছেলেমেয়েকে আমার ভ্রমণের গল্প শুনিয়েছি। আগামীতে আশা করছি, প্রায় এক লাখ ছেলেমেয়েকে আমার ভ্রমণের গল্প শোনাতে পারব। ভ্রমণ করলে কত কিছু জানা যায়, সাহস জাগে নিজের প্রতি... এমন সব গল্প শুনিয়েছি তাদের। আমি বিভিন্ন দেশে যাই সমতা নিয়ে কথা বলি, বিভিন্ন সেমিনারে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলি। ছেলেমেয়েদের ভ্রমণের বিষয়ে অনুপ্রাণিত করি।

তিনি আরও বলেন, ভ্রমণ মনকে প্রসারিত করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে, বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত হয়। ভ্রমণের পাশাপাশি আমি একজন চেঞ্জমেকার, মোটিভেশনাল স্পিকার। এ ছাড়া আমার একটা ছোট ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। আমি খুলনায় একটি ছোট লাইব্রেরি করেছি। মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।

তরুণদের উদ্দেশ্যে কাজী আসমা আজমেরী বলেন, বিশ্বটাকে দেখার চেষ্টা করো, বিশ্বে অনেক কিছু আছে, অনেক জানার বিষয় আছে। তোমরা অনেক কিছু জানতে পারবে। আর নারীরাও যেন ভ্রমণ অবশ্যই করে, তাহলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে অনেকগুণ। তরুণরা বেরিয়ে পড়ো, ঘুরতে শুরু করো। টাকা জমিয়ে বিদেশে ঘুরো, অভিজ্ঞতা বাড়তেই থাকবে।  

তিনি বলেন, আমি বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়ে দিতে চাই। ভ্রমণে যে খরচ তা খুব বেশি নয়, প্রথমদিকে একটু খরচ হলেও পরে সব বুঝে গেলে খরচ আরও কমে যাবে। আর আমি তো একটি শাড়ি না কিনে বরং প্লেনের টিকিট কিনি। তাই বলব ইচ্ছেটাই প্রধান।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৩
এইচএমএস/আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।