পাহাড়, মেঘ আর আকাশের মিতালি। স্রোতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।
ভাবছেন, কল্পনাবিলাসী কোনোও লেখকের নিখুঁত বর্ণনা? মানুষকে বিভ্রান্ত করার দারুণ প্রয়াস? ভাবতেই পারেন! এই বর্ণনাকে আমিও কল্পলোকের কল্পকথাই ভাবতাম, যদি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা না হতো! সত্যিই, এ এক অনুপম আশ্চর্যময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না! লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে থাকা এই মায়াময় স্থানটির নাম ‘লোভাছড়া’।
লোভাছড়া স্থানটি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নে অবস্থিত এক মনোরম স্থান। আসলে লোভাছড়া একটি চা বাগানের নাম। আর এই লোভাছড়া চা বাগানের নামেই মূলত গোটা এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে।
সিলেট থেকে বাসে বা সিএনজিতে কানাইঘাট পৌঁছে সেখান থেকে সুরমা নদীর বুক চিঁড়ে নৌকা করে যেতে হয় লোভাছড়ায়। আর এই নৌকায় ওঠার পর থেকেই শুরু হয় নাগরিক কোলাহলমুক্ত, বিষের বাতাসমুক্ত ও যান্ত্রিকতার দাবানল ছাড়া স্নিগ্ধ-সুশোভিত এক নতুন পথচলা।
নৌকা চলার কয়েক মিনিট পরেই যে কেউ হারিয়ে যাবে নিজসত্ত্বা থেকে। ইঞ্জিন নৌকার বটবট শব্দ, নৌকার ঝাঁকুনি, ঢেউয়ের দোলায় অবাক ছন্দে উপর-নিচ দোল খাওয়া, সীমাহীন আকাশের ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টানো রং, ঝকঝকে সাদা বকের দলের হাওয়ার সাথে ওড়াউড়ি, এ সব কিছুই যে কাউকে নিজের অজান্তেই টেনে নিয়ে যাবে ভাবনার উন্মাসিক এক জগতে।
বিশাল নদীর দু’পাড় দিয়ে গরু-মহিষ নিয়ে কৃষকের চলাচল, নদীর চরে গরু-মহিষের জলকেলি, পাহারারত দুরন্ত কিশোর-কিশোরী আর নদীর দু’ধারের চর যেন গভীর নদী থেকে ক্রমে ক্রমে উঠে গিয়ে মিশে গেছে ওই আকাশের সাথে!
স্রোতে ইঞ্জিনহীন ডিঙ্গি নৌকার ভেসে চলা কিংবা পাথর নিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলা বিশালাকার স্টিমার, সেইসাথে স্টিমারকে ঘর-বাড়ি বানিয়ে ফেলা শ্রমিকদের জীবনচিত্র। এ সব কিছু দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথই থাকে না! বড় বড় স্টিমারের ছুটে চলার পথ বেয়ে নদীজলের আস্ফালন, বিশাল সব ঢেউ বুকে অদ্ভূত শিহরণ বইয়ে দেয়।
নদীপাড়ের মানুষের জীবনচিত্র দেখতে দেখতে কখন যে আপনি পৌঁছে যাবেন সেই কাঙ্ক্ষিত লোভাছড়ায়, টেরই পাবেন না। মনে মনে হয়তো ভাববেন, এতো চমৎকার সব দৃশ্য অবলোকনের পর লোভাছড়ায় আর কিইবা দেখবো! দেখার অনেক কিছুই আছে!
লোভাছড়ায় যেখানে গিয়ে আপনার নৌকা থামবে, সে জায়গাতেই নদীর পাথুরে পাড় দেখে আপনি বিস্ময়ে হতবাক হবেন নিশ্চয়ই। আর পাশেই চারদিকে বিশালাকার ডালপালা নিয়ে স্বগর্বে দণ্ডায়মান বটবৃক্ষকে ঘিরে চা শ্রমিকদের চা পাতা নিয়ে কাজকারবার দেখতে আপনি হয়তো থমকে যাবেন। এরপর দু’তিন মিনিট হাঁটলেই হারিয়ে যাবেন সবুজ নিসর্গের মাঝে।
হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়বে লোভাছড়ার বাসিন্দাদের ছোট ছোট কুটি। কুটিগুলোর সে এক অদ্ভুত নির্মাণ। কুটির থেকেই চেয়ে থাকা ছোট্ট শিশু-কিশোরদের মায়াবী চাহনি দেখে আপনার মনে হবে এমন চাহনি কতোদিন যে দেখিনি!
আপনি হাঁটছেন আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। আপনার মুগ্ধতা আরো বাড়িয়ে দেবে বিশাল এক হাতিকে মাহুত নিয়ে যাচ্ছে দেখে। সারি সারি চা গাছ, মুকুলসহ চায়ের পাতা, ঘন নিবিড় বন থেকে ভেসে আসা পাখ-পাখলির গুঞ্জন আপনাকে বিমোহিত করবে।
পথের এক জায়গায় পেয়ে যাবেন শত বছরের পুরনো বিরাটাকায় এক বট বৃক্ষ। এমন বৃক্ষ আপনি আর কোনোদিনও দেখেননি, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়! চারপাশে শতাধিক ডালপালা নিয়ে স্বদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষটি যেন নিজেকে এই লোভাছড়া চা বাগানের কর্ণধার ঘোষণা করছে! গুচ্ছমূলের বটবৃক্ষটির গোড়ায় রয়েছে নানান রঙ্গের ফুলের সমারোহ। আর বটবৃক্ষের গায়ে মানুষের পাঁজরের হাঁড়ের মতো অবিকল দৃশ্য দেখে আপনি বিস্ময়ে হতবাক হবেন! বৃক্ষটির প্রাচীন গা জুড়ে জন্ম নিয়েছে অমূল্য সব অর্কিড। আর এই বটবৃক্ষটিকেই নিজের প্রিয় আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী।
চারপাশের মন মাতানো সবুজের শ্যামলীমায় মুগ্ধ হয়ে আপনি হাঁটছেন ক্লান্তিহীন। হঠাৎ করেই থমকে যাবেন, এ কি! রাঙ্গামাটিতে চলে এলাম নাকি! আপনার এই বিস্ময়ের কারণ রাঙ্গামাটির মতোই একটি ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে এই লোভাছড়ায়! আপনি আরো বিস্মিত হবেন, যখন দেখবেন ব্রিজটির গায়ে খোদাই করে লেখা রয়েছে- ব্রিজটি নির্মিত হয় ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে! ৩ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ঝুলন্ত ব্রিজ আপনাকে ঘোরের মধ্যে ফেলবে যে, সেই আমলে এই বনভূমিতে ৩ টন ধারণক্ষমতার কোনো যানবাহন চলতো! কারা বসবাস করতো এখানে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনাকে ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এই ব্রিজ থেকে চারপাশে উঁচু উঁচু আকাশ ছোঁয়া পাহাড়সারি দেখে আপনি হা করে চেয়ে থাকবেন। কিন্তু তারচেয়ে বেশি মুগ্ধতা কাজ করবে, যখন দেখবেন একটু দূরেই ভারত সীমান্তে পাহাড়ের সাথে মেঘ আর আকাশ মিশে আছে! এই দৃশ্য যে আরো কতো সুন্দর হতে পারে, সেটা আপনি আরেকটু পরেই টের পাবেন!
লোভাছড়া চা বাগান থেকে বেরিয়ে আবার নৌকাযোগে আপনি একটু উত্তর-পূর্বে যাবেন। যেখানে রয়েছে পাথর কোয়ারি। এই অংশটাও লোভাছড়ার অধীনে। যেতে যেতে মনে হবে আপনি ওই দূরের পাহাড় স্পর্শ করতে যাচ্ছেন। নদীর বুক থেকে শত শত শ্রমিক নীরবেই তুলে চলেছে টন টন পাথর। এ যেন সাগর সেঁচে মুক্তো তোলা! আপনার নৌকা ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। আপনি অবাক হয়ে দু’ধারের আকাশসম সবুজ পাহাড় দেখে চলেছেন।
নৌকা এসে থামবে একেবারেই ভারত সীমান্তঘেষা জায়গায়। খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন লাল ঝান্ডা উড়িয়ে নদীর তীর ঘেষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। আছে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি সদস্যদের সতর্ক পাহারা। তারা আপনাকে কিছুই বলবে না, যতোক্ষণ আপনি বাংলাদেশ সীমান্তে আছেন।
এই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে আপনি যেটা ভাববেন- পাহাড়-মেঘ-আকাশ-সবুজারণ্য এমন করে মিতালি গড়তে পারে!! আপনার মুখ থেকে শুধু একটি শব্দই বেরিয়ে আসবে- অপূর্ব! যে নদীর বুক চিরে আপনি এখানে এসে পৌঁছেছেন, সেটাকে মনে হবে ওই হাত বাড়ানো দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়সারি থেকে নেমে এসেছে যেন!
নদীর তীরে মিহি কণার বালুচরে নেমে আপনি ছুটে যেতে চাইবেন ওই পাহাড় আর মেঘের কাছে। কিন্তু সীমান্তের বাধন আপনাকে আটকে দেবে। তবু আপনার মন খারাপ হবে না, এমন দৃশ্য যে সাত জনমে একবার দেখা যায়!
আপনার ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলবে অবিরাম। প্রকৃতির এমন উদার চিত্তের সৌন্দর্যচিত্র কেইবা হাতছাড়া করতে চাইবে! তারপর ইচ্ছে করলেই আপনি নেমে যেতে পারেন স্বচ্ছ জলের ধারায়। মেতে ওঠতে পারেন অবাক জলকেলিতে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। লোভাছড়ায় এখনো পর্যন্ত নেই কোনো থাকার ব্যবস্থা। গড়ে ওঠেনি হোটেল-মোটেল। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে ফেরার পথ ধরতেই হবে। আপনার মন বলবে- সময় বহে যাক, নদীর স্রোত থেমে যেতে চাইলে থেমে যাক, আমি এই জায়গা ছেড়ে যেতে চাই না। কিন্তু না, আপনাকে ফিরতেই হবে। মাঝির ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি কিংবা জারি-সারি গান শুনতে শুনতে নিজ গন্তব্যের পথ ধরবেন আপনি। কিন্তু নিজেকে আপনি হারিয়ে আসবেন ওই লোভাছড়ায়!
যেভাবে যাবেন
দেশের যেকোনে জায়গা থেকেই সিলেট এসে বাসে করে ৬০ টাকা দিয়ে যাওয়া যাবে কানাইঘাট। অথবা সিলেট থেকে সিএনজি রিজার্ভ করেও যাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ভাড়া নেবে ৬০০ টাকার মতো। কানাইঘাট থেকে নৌকা করে লোভাছড়ায় যেতে জনপ্রতি ভাড়া নেবে ৩০-৪০ টাকা করে। চাইলে রিজার্ভ নৌকাও নিতে পারেন।
যা সঙ্গে নেবেন
ক্যামেরা, দুপুরের খাবার, পানি, হালকা নাশতা, লুঙ্গি বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।
সাবধানতা
একা একা বনে ঢুকলে বিপদ হতে পারে। দলবেধে চলবেন, নয়তো পথ হারিয়ে ফেলতে পারেন। নদীতে জলকেলি খেলার সময় গভীরে যাবেন না। সাঁতার না জানলে নদীতেও নামবেন না। নদী তীরে কোথাও ডুবোচর আছে কিনা, স্থানীয় মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেবেন। লোভাছড়ায় ঢোকার সময় জুতো পরে নেবেন। সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করবেন না ভুলেও।
ভালো হয়
যদি স্থানীয় কারো সাথে যোগাযোগ করে সেখানে যেতে পারেন। অথবা আগে সেখানে গিয়েছে, এমন কাউকে সঙ্গে রাখলে আপনার চিন্তা এনকখানি কমে যাবে।
লেখক: রফিকুল ইসলাম কামাল
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেটভিউ টোয়েন্টিফোর ডটকম
বাংলাদেশ সময়: ১০০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৪