ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

শরতে চলন বিলে

লিয়াকত হোসেন খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪
শরতে চলন বিলে ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ষড়ঋতুর দেশ এই বাংলায় ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস নিয়ে শরত্কাল। এই শরতে বিল অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে দারুন আনন্দ পাবেন আপনি।

বিলের আশপাশের একটু উঁচু অনাবাদি জমিতে দিনভর বাতাসে দোল খায় কাশফুল।

আর কাশবনের পাশ দিয়ে যদি রেলগাড়ি যেতে দেখেন, তাহলে তো কথাই নেই। তখন মনের কোণে এসে জেগে উঠবে ‘কাশের বনে ঢেউ খেলিয়ে তুফান মেল যায়-  তুফান মেল যায়-’ গানের কথাগুলো। এই শরতে বেড়ানোর জন্য চলনবিলের তাড়াশ, গুরুদাসপুর কিংবা এর আশপাশের এলাকা বেছে নিতে পারেন নিশ্চিন্তে।

শরতে চলনবিলের তাড়াশের রূপের কোনো তুলনাই নেই। গাছে গাছে কত না রঙের ফুল। কামিনী, কদম, শিউলি, হাসনাহেনা ফুটে সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে দিনে-রাত সমান তালে। শরতে ছায়া ঢাকা মায়ামাখা তাড়াশ যেন একখানি ছবি।

ছবির মতো রূপ দেখে হয়তো আপনার মনে জেগে উঠবে ‘হেরিনু শারদ প্রভাতে/হে মাতবঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোভাতে/ কবিতার এই চরণগুলো।

তাড়াশের আশপাশে রয়েছে নদনদী ও খালবিল। এ সবকিছুই বয়ে গেছে চলনবিলের ওপর দিয়ে। শরতে বিল অঞ্চল অফুরন্ত জলে থৈ-থৈ করে। আকাশে কে যেনো রং তুলি নিয়ে সাদা আর নীলের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। আত্রাই, গুড় , বরনাই , বড়াল , তুলসী,  চেঁচুয়া , ভাদাই নদীতো বয়ে গেছে চলনবিলের ওপর দিয়ে।

মেঘ গর্জন করলেই- অঝোর ধারায় নেমে আসে বর্ষণধারা। তখন নৌকা ভাড়া করে দূরে, বহু দূরে চলে যেতে পারেন।

এভাবে বেড়াতে চাইলে কয়েক বন্ধু মিলে গেলে ভালো হয়। চলনবিলে নৌকায় ৩ থেকে ৪ রাত কাটিয়ে দারুণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। নৌকা যখন কোনো তীরে এসে ভিড়বে, তখন পাশে দেখবেন সাদা কাশফুল। সুযোগ পেয়ে কাশেরা পুরো এলাকা জুড়েই বসতি গেড়েছে।

কাশবনে পাখিরা সকাল-বিকাল আড্ডা দেয়। মন তখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে। হয়তো মনে জেগে উঠবে, ‘বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর/গাঙ-শালিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।

৩ থেকে ৪ দিনের জন্য নৌকা ভাড়া নেবে ২ হাজার টাকা। রান্নাবান্না হবে নৌকাতেই। সে কি আনন্দ! শরতে আকাশ মেঘলা হয়ে উঠলে তো বৃষ্টি নেমে আসবেই। তখন বিলের রূপ অপরূপ হয়ে ওঠে। কোনো তীরে নেমে মাটিতে পা রেখে কাছ থেকে দেখা হবে শিউলি ফুল।

যা দেখবেন
তাড়াশে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ রাধা গোবিন্দ মন্দির,  রশিক মন্দির, শিব মন্দির, বড় কুঞ্জবন দীঘি, উলিপুর দীঘি, মথুরা দীঘি, মাকরসন দীঘি।

শরতের শেষ দিকে শুরু হয় দুর্গাপূজা। তখন তো এখানকার গোবিন্দ মন্দিরে বাজে ঢোল-বাদ্য, আকাশে ওড়ে ফানুশ। কীর্তন গানে মুখরিত হয় তাড়াশের আকাশ-বাতাস। আর তাড়াশের চারদিকে ফুটে থাকে কত শত কাশফুল।

তাড়াশে বেড়াতে গিয়ে জানবেন, এখানকার কপিলেশ্বর শিব মন্দির, কালিকা দেবীর মন্দির, বাসুদেব ও গোপীনাথ বিগ্রহের মন্দির বিখ্যাত। তাড়াশ রাজবংশের পূর্বপুরুষ বলরাম রায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মন্দির।

দেখবেন কুঞ্জবন নামের সর্ববৃহৎ জলাশয় এবং তাড়াশের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন কীর্তির নিদর্শন। তাড়াশের ভগ্নপ্রায় জোড় বাংলার গায়ে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে  খোদিত লিপি থেকে জানা যায়- এখানকার গোপীনাথ বিগ্রহের সেবায়েত ছিলেন নাগবংশীয় কায়স্থ।

এই তাড়াশে বিনোদ রায়, গোবিন্দজী, রশিক রায়, কপিলেশ্বর শিব প্রভৃতি যে কয়টি বিগ্রহের মন্দির আছে, এর মধ্যে কপিলেশ্বর শিব মন্দির অন্যতম। এসব দেখতে দেখতে ফিরে যাবেন অতীত যুগে। অতীত যুগে ফিরে যাওয়া মানেই নস্টালজিয়ায় ভোগা।

তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠবে পূজা পার্বণের সেই দিনগুলোর কথা। দেখবেন, এখানকার প্রতিটি মন্দিরের গায়ে রয়েছে অপরূপ কারুকাজ। প্রাচীনকালে ক্ষুদ্র ইট দিয়ে এসব মন্দির তৈরি হয়েছিল।

একসময় তাড়াশের নাম শুনেই মনে ত্রাস বা তরাসের সৃষ্টি হতো। অনেকেই অনুমান করেন,  ‘তরাস’ শব্দ থেকেই তাড়াশ নামের উত্পত্তি হয়েছে।

তাড়াশের কাছে পিঠে বিনসারা গাঁও। রিকশা নিয়ে বিনসারায় যেতে পারেন। জানবেন, কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বাস ছিল এখানে। বিনসারায় গিয়ে কয়েকটি কূপও দেখবেন, একটি কূপের নাম ‘জীয়ন কূপ’। এই কূপটি বড় অদ্ভুত ধরনের। বড় বড় আগলা ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত এটি।

ওখানে গিয়ে লোকমুখে আরও জানবেন, বাছো বানিয়া মনসা পূজারী ছিলেন। ‘দুধপুকুর’ নামে তার একটি পুকুর ছিল। পুকুরটি সাপদের জন্য নাকি দুধে ভর্তি থাকত। এখনও আছে দুধপুকুর, তবে সেখানে দুধ নেই, সাপও নেই।

দুধপুকুর দেখার সময় তবুও কেন জানি ভয় ভয় লাগবে। সাপ না দেখলেও এখানকার জঙ্গলে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে সাপ। যা রাতের বেলা বের হয়ে আসে।

তা সত্ত্বেও বেড়াতে এসে চারদিকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়বেন।

যেখানে থাকবেন
তাড়াশে রাত্রিযাপন করার জন্য ডাকবাংলো রয়েছে। একটি কক্ষে ২টি সিটে দৈনিক ভাড়া ১০০ টাকা। তাড়াশ থানার কাছেই ডাকবাংলো। এছাড়া গণকল্যাণ সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন বিভাগের ভিআইপি রুম রয়েছে।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়কপথে বাসে তাড়াশ যেতে হবে। রাজশাহীগামী এনপি এলিগেন্স কিংবা ন্যাশনাল পরিবহনে উঠে মহিষলুপিতে নামুন। মহিষলুপি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে তাড়াশ। ভ্যানগাড়িতে ৪ যাত্রী ওঠানো হয়। জনপ্রতি ভাড়া নেয় ১০ টাকা। আর ঢাকা থেকে বাসে মহিষলুপি পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

যেখানে খাবেন
খাওয়া-দাওয়ার জন্য তাড়াশে ভালো রেস্টুরেন্ট হলো শুভ হোটেল। রুই মাছ কিংবা কাতল মাছ দিয়ে একবেলা খেতে খরচ পড়বে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এতে পাবেন ২ প্লেট ভাত, ১টা ডাল ও এক টুকরা মাছ, সঙ্গে থাকবে যে কোনো একটা তরকারি।

বারুহাস গ্রাম
তাড়াশের কাছেপিঠে বারুহাস গাঁওখানি প্রাচীন ও জমিদারপ্রসিদ্ধ গ্রাম। এখানে গিয়ে একটি ইমামবাড়ার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাবেন।   শুনবেন, এটি শাহ সুজার আমলে নির্মিত হয়েছিল। এখানে একজন দরবেশের মাজার আছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন।

কারও মুখে শুনবেন, তিনি এখানে বসে এবাদত করতেন। পঙ্খিরাজ ঘোড়ার পিঠে তরবারি হাতে মানুষের ছবি বাংলোটির গায়ে থাকায় এটি মুসলিম কীর্তির নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন। মোগল আমলে ইমাম-মোয়াজ্জেমের হুজরাখানার জন্য এরূপ বাংলো নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন বারুহাস গ্রামে বিরাট মেলাও বসে।

বারুহাস গাঁয়ে ঘুরতে ঘুরতে যদি শেফালি গাছের তলায় আসেন, তখন ঝকমকে আকাশ, ঝলমলে রোদ খুঁজে পেলে তো কথা নেই। আকাশে তাকিয়ে দেখুন না। হয়তো দেখবেন, শরতে সারা আকাশে শুভ্র পেজা তুলার মতো বারিহারা মেঘের অবিরাম ছোটাছুটি চলছে।

যত খরচ হবে
তাড়াশ এবং এর পাশে বেড়ানোর জন্য এক সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে যাবেন। এ ভ্রমণে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলেই চলবে। তবে একত্রে ৪ থেকে ৫ জন বন্ধু মিলে গেলে ভালো হয়। তাহলে শরত ঋতুতে চলনবিলের তাড়াশে গিয়ে ভ্রমণের দিনগুলো আনন্দেই কাটবে।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।