ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যেতে যানবাহনের তেমন কষ্ট নেই। শুধু দূরত্বটাই বেশি।
শহর থেকে একটু দূরে, প্রকৃতির ছায়া ঘেরা গ্রাম ছেঁউড়িয়া। যেখানে লালন ফকিরের আখড়া। রিকশা বা অটোরিকশায় খুব সহজেই যেতে পারেন এখানে। যাওয়ার পথে অনেক পুরাতন বাড়ি (ব্রিটিশ আমল ও তার পরের) ছাড়াও দেখতে পাবেন মোহিনী মিল।
আখড়া এলাকায় পৌঁছানোর পর কাউকে বলে দিতে হবে না, আপনি কোন দিকে যাবেন। শুনতে পাবেন কাছেই কোথাও বাজছে একতারা, দো'তারা, ঢোল ও বাঁশি। আর সেই বাদ্যযন্ত্রের সুরের মধ্য দিয়ে অদেখা দেখার আকাঙ্খা ব্যক্ত করছে কোন ফকির। ফকির বললাম এই জন্য, লালন সংগীত যারা গান, তারা নিজেদেরকে বাউল বলেন না, ফকির বলতেই সাচ্ছন্দ বোধ করেন।
ছফেদ রঙের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই আপনার প্রথমে চোখে পড়বে, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”। ধূপমান নেশাকে নিরুৎসাহিত করে লালন ফকিরের একটি বানী ‘গাজায় দম চড়িয়ে মনা/ বোমা কালী আর বলিস নারে’।
প্রতীক্ষিত লালনের মাজার দেখতে আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না, ঢুকতেই দৃষ্টিগোচর হবে।
সেখানে লালন শাহের মূল মাজারের আঙিনায় আরো অনেক ফকিরের মাজার আছে। লালনের মাজার ঘরটা ভেতরে। যার এক পাশে তাঁর, আর অন্য পাশে পালক মাতার কবর, আর বাইরে তার পালক পিতা মওলানা মলম শাহ, দাসী ও অণ্য আরো কয়েকজন মুরিদের কবর।
তার পাশেই দেখবেন একাডেমিক ভবন, পাঠাগার, রিসার্স সেন্টার ও অডিটরিয়াম। তবে অনেক ফকির (লালনের অনুসারী) সেই অডিটরিয়ামে উঠেন না। আমি এক ফকিরকে জিজ্ঞেস করলাম কেন ওপরে উঠেন না। তিনি বললেন, আমার গুরু নিচে শুয়ে আর আমি তার উপরে উঠব? গুরুর প্রতি তার ভক্তি দেখে আমি বিমোহিত হলাম।
কিছু কবরের সামনে লালনের নিজ হস্তে মুরিদ লেখা দেখে আমি ওই ফকিরকে বললাম, আপনারা কি সবাই মুরিদ? মানে লালনের যারা ভক্ত তাদেরকেই কি মুরিদ বলে?
তার জবাব না, লালন সাঁই সবাকে মুরিদ করতেন না। এ প্রসঙ্গে উনি একটি কাহিনী বললেন, "লালনের জীবদ্দশায় একবার ভারত থেকে কিছু লোক এসেছিলেন তার মুরিদ হতে, মানে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে। তারা জানতো লালনের কিছু আধ্যাত্মিক শক্তি ছিলো। তাই তারা কিছু চুন এনেছিল কি রকম আধ্যাত্মিক শক্তি আছে তা তা পরখ করার জন্য। লালন তাদেরকে শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করলে তারা তা পান করে বলেছিল আমরা আপনার জন্য কিছু চুন এনেছি যা আমরা শরবত হিসাবে সব সময়ই খায়।
লালন বললেন ঠিক আছে, আমি খাচ্চি তবে তোমরাও এ থেকে কিছু পান কর। তারা না না করছিল আর বলছিল, যে আপনি গুরু আপনার সামনে খাবনা। শেষমেশ তারা খেতে অপারগতা প্রকাশ করে।
লালন তাঁর ভক্তদের বলে খাও, তারা কোন রকম দ্বিধা না করে ঢক ঢক করে পান করা শুরু করে দেয়। তখন লালন বলেন, দেখ এরাই আমার প্রকৃত ভক্ত ।
একাডেমিক ভবনের নিচতলায় লালন জাদুঘর। প্রবেশ করতে টিকেট কাটতে হয়। মূল্য মাত্র ২ টাকা। সেখানে ফকিরদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ছাড়াও কিছু পেইন্টিং আছে।
এবার ফেরার পালা। কিন্তু গেটের পাশেই রাস্তার ওপারে দেখবেন, অনেক কুটির শিল্পের দোকান। একতারা দোতারা, বাউল শোপিস।
আর তারপরই বিশাল খোলা মাঠে লালনের একটি প্রতিকৃতি। এখানে গানে আসর হয় কিংবা যারা পিকনিকে আসেন তারা রান্নাবান্না করে।
আখড়াবাড়ি দর্শন শেষে যদি একটু প্রকৃতির শীতল পরশ পেতে চান, যেতে পারেন গড়াই এর তীরে। যেখানে গেলে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়বেই।
আমাদের ছোট নদী চলে একে বেঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
ফজলে রেজওয়ান করিম: নিউজ রুম এডিটর, মোহনা টেলিভিশন