বসন্তের নির্মেঘ আকাশে বসে মহাশক্তিমান সূর্যদেব প্রকৃতির উপর মেজাজ দেখাচ্ছেন। নীচে পাহাড়ি উপত্যাকায় বসন্ত দিনে তাই আগুন লেগেছে চারপাশে।
থানচি আলি কদম রাস্তা ধরে যারা এখনো যাননি তারা অন্তত অ্যাডভেঞ্চারের জন্য হলেও বাইকে পুরো পথটুকু পাড়ি দিতে পারেন। কথা দিচ্ছি তাতেই অ্যাড্রোনালিনের ষোলকলা পূর্ণ হবে। চিম্বুকের পিঠ ধরে এগিয়ে যাওয়ার ফাঁকে ওইতো উঁকি দিয়ে গেলো ডিম পাহাড়। আবার সে হারায় পাহাড় সারির আড়ালে। পথের ভয় তো আছেই, সাথে আলি কদমে নেমে যোগ হয়েছে শেষ পর্যন্ত গন্তব্য পর্যন্ত যেতে না পারার অনিশ্চয়তা। সেখানে বিভিন্ন বাহিনীর উপদ্রপ। সেনাবাহিনী নাকি তাদের সঙ্গে পেরে উঠে না।
এই বলে অটোচালক প্রস্তাব দিলেন পারবেন না যাইতে, তার চেয়ে চলেন আলির সুড়ং ঘুরাইয়া আনি। চাটগাঁইয়া উচ্চারণের কথাগুলো সত্যিই ভয় ধরিয়ে দিলো। অনেক কষ্ট করে ছুটি ম্যানেজ করে তবেই এসেছি। এখন খালি হাতে ফিরে যেতে হলে ঢাকায় বসে আগামী চারদিন কি ঘাস কাটবো?
সিদ্ধান্ত হলো এগিয়ে যাওয়ার, গিয়েই দেখা যাক না। একপ্রস্থ নাটক হয়ে হয়েছে সকালে। রাতে আমাদের বাস ছাড়ে ফকিরাপুল থেকে। মাঝরাতে বিলাসদার বন্ধুর মারফত কুমিল্লার বিরতিতে ভরপেট ভোজ। সকাল সাতটার দিকে বাস নামিয়ে দিলো চকরিয়ায়। সেখানে ঠাকুর বিলাসের আরেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। এক কথা দুই কথায় আলি কদমগামী জিপে তিনিও চড়ে বসলেন আমাদের সঙ্গে। নতুন সঙ্গী যোগ হলো কির্সতং রুংরাং অভিযানে।
লামা পার হয়ে দেড় ঘণ্টা পর জিপ নামিয়ে দিলো আলি কদম। চকরিয়া থেকে আলি কদমের রাস্তাটি অসাধারণ। মসৃণ পিচঢালা রাস্তায় খুব বেশি যানবাহনের দৌরাত্ম্য নেই। রাস্তার দু’পাশে তামাকের খেত মিশেছে পেছনের পাহাড় সারির গোঁড়ায়। তার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ি মানুষদের টংঘর। খানিকটা সময় সঙ্গ দেবে মাতামুহুরি। এই সময় তার স্রোতে ধার নেই। বসন্তের এ সময় কোকিলের ডাক কানে গেলো না। রৌদ্র ঝলমল দিনে সূর্যে পোড়া পাহাড় বনের আলাদা এক ধরনের সুর আছে। কান পাতলে ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে তা টের পাওয়া যায়।
আলি কদমে পৌঁছে ঝটপট খেয়ে মোটরসাইকেল ভাড়া করা হলো। এর ফাঁকে আমাদের নতুন সঙ্গীটি বেঁকে বসলেন। তিনি যাবেন না। তার মমতাময়ী মা মোবাইল ফোনের ওপাশ থেকে দিব্বি দিচ্ছেন না যেতে। তার আশংকা সেখানে গেলে পুত্র বিপদের মুখে পড়তে পারে। মায়ের আদেশ, তিনি ফেরে গেলেন আর আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম। দুটো মোটরসাইকেল তিনশো টাকায়। জনপ্রতি একশ টাকা। নামিয়ে দেবে ১৩ মাইল পর্যন্ত। দশ মাইলে গিয়ে থামতে হলো।
আর্মি চেকপোস্ট আছে। অবশ্য চেকিংয়ের ঝামেলা আমাদের পোহাতে হলো না। ড্রাইভারদের পরিচয়পত্র এখানে জমা রাখতে হয়। দুই মিনিটে কাজ শেষ। আবার ছুটলো বাহন। সেই সঙ্গে আমাদেরও ঘাম ছাড়লো। যাক অন্তত আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হবে না। এরপর আর কোনো চেকপোস্ট নেই। থানচি আলিকদম সড়ক এখন দেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার মোটরগাড়ির সড়ক। গড়ে ২৫শ ফুট উচ্চতার এ নবনির্মিত সড়ক চিম্বুক রেঞ্জের পাহাড় কেটে যুক্ত করেছে থানচি আলি কদম উপজেলাকে।
এ সময় এলে পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য বোঝা যায় না। বর্ষা বিদায় নিয়েছে অনেকদিন। বৃষ্টি হয়নি কাছাকাছি সময়ে। রুক্ষ পাহাড়ি মাটিতে তাই বিবর্ণ গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের সমাহার। কিন্তু এর মাঝে কোথাও যেন এক উদাস করা সুর বেজে চলেছে। দূরে অজানা পাহাড়গুলো সবচেয়ে বড় যন্ত্রী। মাঝে মাঝে গরম হাওয়ার ঝটকা বুঝিয়ে দিচ্ছিলো নেমে একবার হাঁটা শুরু করে টের পাবে মজা। মোটরসাইকেল নামিয়ে দিলো তেরো মাইলে।
চলবে....
বাংলাদেশ সময়: ০১২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৬
এএ