মেনিয়াঙ্ক পাড়ার পথ সম্পর্কে তখনও ধারণা না থাকলেও এতোটুকু বুঝতে পারছিলাম এ গরমে একেবারে জান বের করে ফেলবে। ওরা দু’জন ফিরে আসতেই রাজীবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঝিরি ধরে আবার এগোতে লাগলাম।
এখন সূর্য একেবারে মাথার উপরে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ঝিরির শীতলতাও তার তাপের কাছে ম্রিয়মান। কিছুক্ষণ হাঁটার পরপরই থামতে হচ্ছে। মনে মনে বললাম এখনই এ অবস্থা, চড়াই শুরু হলে না জানি কি হবে! ব্যাপারটি যে আসলেই গুরুতর তা বুঝলাম একটু চড়াই ভেঙে। জায়াগাটুকু পার হয়ে আবার ঝিরি পড়লো। সেখান থেকে রুংরাং চূড়া দূরে দেখা যাচ্ছিলো দুটো পাহাড়ের ফাঁক গলে। এটি হিমালয় না, বাংলাদেশের প্রায় সমতল। কিন্তু এই গরমে দুই আড়াই হাজার ফুট ওঠার চিন্তা করতেও সাহস লাগবে বৈকি।
পরিস্থিতি মাঝে মধ্যে সহজ পথকেও কঠিন করে দেয়। শেষবারের মতো পানি ভরে নিলাম বোতলে। লিউ ল জানালো এর পরে আর কোনো ঝিরি নেই পাড়া পর্যন্ত। একই সঙ্গে পথের ভয়াবহ চড়াই সম্পর্কে জানাতেও ভুললো না। এ চড়াই আসলেই একটু বেশি খারাপ। একটু পথ চলি একটু থামি।
এবার পাহাড়ি পথে চলার চিরায়ত নিয়ম অনুসরণ করা শুরু করলাম। সামনে একটি লক্ষ ঠিক করে নেই। সেখানে পৌঁছে একটু জিরিয়ে আবার নতুন লক্ষ্য। পথের এক দিকে পাহাড়ের দেয়াল আরেকদিকে খোলা। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা একেবারে সরু। উচ্চতা ভীতি আছে এমন কারও জন্য ওইটুকু রাস্তা বেশ ভীতিকর। ব্যাকপ্যাকের ভার সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গরমে হাঁটা ধীর হয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য পথের বা পাশের রূপ বড়ই মোহনীয়। দুপুরের সূর্য পশ্চিমে হেলতে হেলতে পাহাড়ের গায়ে রোদের দংশন দিয়ে যাচ্ছে। জুমের পুড়ে যাওয়া বিবর্ণ পাহাড়ের রূপও বড়ই মনোহর। কিন্তু আমাদের কি সে সময় আছে। বিলাস দা প্রথমদিকে বেশ এগিয়ে ছিলো। বেচারা কেবল ডায়রিয়া থেকে উঠেছে। তার স্ট্যামিনা মুগ্ধ করছিলো। আর জুয়েল থিওটিয়াসের তো দেখাই নেই। এক খাড়াইয়ের মাথায় উঠে দেখলাম আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
মনে হলো কত যুগ ধরে উঠছি। আসলে খুব বেশি হলে চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট উঠেছি। এরপর আরেকটি চড়াই উঠে সামনের দিকে তাকিয়ে অবশেষে মনে হলো সুন্দরের দেখা পাওয়া গেলো। যে জায়গাতে উঠে এসেছি সেখান থেকে সামনের দিগন্তের কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
দূরে কুয়াশামোড়া শেষ বিকেল নেমে এসেছে পাহাড়ের আড়ে। পশ্চিম দিগন্তের সেই পাহাড় চূড়ার উপরে ওড়াউড়ি করছে পাখির ঝাঁক। ক্লান্তি এখানে শেষ হয়ে যায় কিন্তু উঠতে সায় দেয় না।
কানের কাছে বলে কি হবে পথ চলে এখানেই একটু ঘুমিয়ে নাও। সবাই চলে আসার পর বেশ অনেকক্ষণ জিরিয়ে আবার উঠতে শুরু করলাম। এখানে থেকে মেনিয়াঙ্ক পাড়ার কিছুটা দেখা যাচ্ছিলো।
এ দৃশ্য সাহস জোগালো। অন্তত পাড়ায় পৌঁছাতে পারবো আজ। একটু একটু করে এগিয়ে পাড়ার কাছাকাছি গিয়ে পানির দেখাও পেলাম। কিন্তু দেখেই মনে হলো এ পানি খেলে নির্ঘাত ডায়রিয়া।
লিও ল আর মাঙিয়াঙ্গ দিব্যি তা খেয়ে নিলো। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এক সময় পাড়ায় পৌঁছে গেলাম। এখানে মুরং জাতির মানুষের বাস। খুবই ছোট। মাত্র ছয় কি সাত ঘর মানুষের বাস। দিনের আলোর বিদায় নিতে এখনও অনেক সময় বাকি। ওই তো রুংরাং পাহাড় চূড়া। ইচ্ছে করলে চূড়া স্পর্শ করে আবার পাড়ায় ফিরে আসা যেত। কিন্তু বিলাস দা আর সায় দিলেন না। পাড়ায় ঢোকার প্রথম মাচাংয়ের উপর নির্জিব হয়ে পড়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করছিলো। লিও ল জানালো এখানে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে। সে নাকি সেখানে খাবে। তাহলে আমরা কোথায় খাবো? এ প্রশ্নে সে ভুরুক্ষেপ না করে তার সেই আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেলো।
আর আমরা শুকনো বিস্কুট চকলেট চিবুতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এলো বিরস মুখে। তার আত্মীয় তাকে খেতে দেয়নি।
যদিও সেখান থেকে সে দুটি টমেটো আর বেগুন নিয়ে এসেছে। পরিকল্পনা হলো টমেটো আর বেগুন ভর্তা করার। অবশ্য কিছুক্ষণ পর আমাদের থাকা খাওয়ার দুশ্চিন্তা দূর করে হাজির খনরুই, মেনিয়াঙ্ক পাড়ার কারবারির ছেলে।
সে তার ঘরে খাওয়া ও থাকার আমন্ত্রণ জানালো। রাতের আইটেমে মুরগিও নাকি থাকছে। আমরা বাউন্ডুলে। এ প্রস্তাব তো রীতিমতো রাজকীয়।
একটি মুরগি চোখের সামনে জবাইও করে ফেললো সে। কিন্তু মুচকি হেসে জানালো রান্নার তেল নাকি নেই। বললাম কুছ পরোয়া নেহি, তেল ছাড়াই হবে মহাভোজ।
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ০৩৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এএ/