ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

গ্রিসে প্রবাসীদের স্বজন প্রকৌশলী জয়নুল আবেদীন

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
গ্রিসে প্রবাসীদের স্বজন প্রকৌশলী জয়নুল আবেদীন নিজের কার্যালয়ে কর্মমগ্ন প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এথেন্স, গ্রিস থেকে: মাত্র সপ্তাহ দুই আগের ঘটনা। গ্রিসের কাতপাতিশেয়া এলাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন কুমিল্লার মোল্লা শহীদ (৫৯)।

অর্থনৈতিক খরার এই দেশে দীর্ঘদিন ধরেই বেকার ছিলেন তিনি। প্রবাসে আপন বলতে কেউ ছিলো না তার।

অসহায় এই প্রবাসীর মৃত্যুর খবর শুনে নিজের ব্যস্ততা ফেলে হাসপাতালে ছুটে গেলেন প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন। দ্রুত ঠিকানা সংগ্রহ করে খবর জানালেন দেশে থাকা মৃতের স্বজনদের। প্রায় লাখখানেক টাকা সংগ্রহ করে দেশে পাঠানো হলো তার মরদেহ।

কেবল এই ঘটনাই নয়, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে কাউকে পুলিশ আটক  করলো, জেলে পুরলো। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজন কারো গ্যারান্টির। কোনো কথা নেই। কমিউনিটির সদস্যদের নিয়ে প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন ছুটে যান সেখানে।

জেলে আটকদের জন্য খাবার দেওয়া বা আইনগত সহায়তার ব্যাপার। সবার শীর্ষে থাকে তার ভূমিকা। আবার প্রবাসে অভিবাসী শ্রমিক-বিরুদ্ধ কোনো নীতি বা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি।

যে কারণে গ্রিসের বাংলাদেশিরা তাকে পরম শ্রদ্ধা করেন। ভালোবাসেন হৃদয় দিয়ে। এই প্রবাসে দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রিয় স্বজন তিনি।

গ্রিসে  প্রবাসীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রয়াসে সকলকে সংগঠিত করে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিস’। এছাড়াও তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ‘অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠনের।

২০১২ সালে ১ ডিসেম্বরে এথেন্সের প্রেসিডেন্ট হোটেলে গ্র্যান্ড কনভেনশনের মাধ্যমে জন্ম নেয় সংগঠনটি। ইউরোপপ্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ, স্বার্থরক্ষা আর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ব করতেই প্রতিষ্ঠা করা হয় সংগঠনটি।

২০১৩ সালের ১৭ মার্চ। বকেয়া বেতনের দাবিতে রাজধানী থেকে সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার দূরে নিউ মানোলদা এলাকার স্ট্রবেরি খামারে ধর্মঘট শুরু করলো বাংলাদেশি কৃষি শ্রমিকরা। মালিকের জোরাজুরিতে কাজে না ফেরায় তাদের ওপর নির্বিচার গুলিতে গুরুতর আহত হন ৩২ বাংলাদেশি।

প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন গ্রিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা নিয়ে ছুটে যান সেখানে। অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে সারাবিশ্বে তুলে ধরেন বর্বর এই ঘটনা। দেশে-বিদেশে এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবিতে গড়ে তোলেন জনমত। বিচারের দাবি তোলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে। এতে টনক নড়ে গ্রিস সরকারের। আহত শ্রমিকদের স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয় দেশটি।

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সুকিপুর গ্রামের কৃষক মৃত আফাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন। দুই ভাই চার বোনের মধ্য তিনি সবার বড়।

১৯৭৫ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে চলে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে, বর্তমান উজবেকিস্তানের তাশখন্দ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা শেষে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ই পড়ার সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক গ্রিক তরুণীর। দীর্ঘ চেনাজানা আর মন দেওয়া-নেওয়ার হিসেব মেলাতে বিয়ে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেই গ্রিক তরুণী মারিয়া সিক্রিনিদিসকে। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে এখন গ্রিসেই প্রতিষ্ঠিত।

জয়নুল আবেদীন দেশে ফিরে ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট  অর্গানাইজেশনে যোগ দেন ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট হিসেবে।
পরে তিনি ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনে।

এরপর জয়নুল আবেদীন জাতিসংঘের আহবানে ১৯৮৯ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট  অর্গানাইজেশনের ইন্টারন্যাশনাল কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন ভিয়েতনামে। এর ধারাবাহিকতায় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ১৯৯০ সালে চলে আসেন গ্রিসে।

সেখানে কাজ করেন ‘এতেপ’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে। এভাবে ১৯৯৬ পর্যন্ত চাকরি শেষে গ্রিসেই শুরু করেন ব্যবসা বাণিজ্য। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি এখানে ব্যবসা শুরু করেন। যে কারণে এখানকার ব্যবসায়ীদের কাছে তার পরিচয় ‘পথ প্রদর্শক’ হিসেবে।

প্রথমে গ্রসারি শপ দিয়ে শুরু। পরে আমদানি-রপ্তানি আর ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা বিস্তৃত করেন তিনি। এখন বেশি ব্যস্ততা প্রবাসীদের নিয়ে। দু‘বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ কমিউনিটির।

আগামী ৭ ও ৮ মে প্লাতিয়া কমুদুরু, অমনিয়া এলাকায় প্রবাসীদের নিয়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন নিয়েই যত ব্যস্ততা তার।

প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন বাংলানিউজকে বলেন, অসহায় প্রবাসীদের পাশে যখন দেখি কেউ নেই, তখন নিজেকে আর স্থির রাখতে পারি না। বলতে পারেন, এসব কাজে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোনো স্বার্থে নয়। তাদের জন্যে কিছু একটা করতে পারলেই যেন মানসিক পরিতৃপ্তি পাই।

অমনিয়ায় কথা হয় মাদারীপুর থেকে এসে গ্রিসে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন দেওয়ানের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, শূন্য হাতে আমি একদিন এসেছিলাম এই দেশে। সেদিন প্রথম যার কাছে গিয়েছিলাম তিনি প্রকৌশলী ড. জয়নুল আবেদীন। আমাদের শ্রদ্ধা আর সম্মানের আসনে বরাবরই রয়েছেন এই মানুষটি। যিনি প্রবাসে আমাদের আপনজন। অভিভাবক, প্রিয় স্বজন।

বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
এইচএ/

**মন্দার বিপরীতে স্বপ্নে বিভোর জহিরুল
**রোদ চশমায় ভাগ্যবদল আনোয়ারের
** গ্রিক নারীর বাংলাদেশ প্রেম
** উত্তরগুলো কেবল অসহায় চাহনিতেই!
** বিদেশি সতীনেও কষ্ট নেই, আছে সুখ!
** ডিশ ওয়াশার থেকে ২ রেস্টুরেন্টের মালিক আকুল মিয়া
**জার্মানিতে বিয়ে বা দত্তক- এতে যায় কষ্টের বহু অর্থ
**পেট্রোলপাম্পেও নিজের কাজ নিজে করো নীতি
**সততা-একাগ্রতাই এগিয়ে নিয়েছে কাজী সুরুজকে
**‘সেই সংগ্রামই সাফল্যের পথপ্রদর্শক’
** আস্থার সংকটে বাংলাদেশ–জার্মানি সম্পর্ক!
** বিমানবন্দরে বাংলাদেশের হাসি

** নিজেই মুমূর্ষু জার্মানির বাংলাদেশ দূতাবাস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।