[পূর্ব প্রকাশের পর]
কথা ছিলো থানচির তিন্দুতে আজকের রাত থাকবো। জঙ্গলে ঢাকা রিজ পার হয়ে খনরুই প্রায় ৯০ ডিগ্রি এক খাঁড়া ঢালে নামতে উদ্যত হলো।
আমরা কেউই রাজি নই এ রাস্তায় যেতে। খনরুইকে বলা হলো উঠে আসতে। সে প্রস্তাব দিলো আবার মেনিয়াঙ্ক পাড়ায় ফিরে যেতে। কিন্তু আমরা ওই রাস্তায় আর যাবো না। সে জানালো তিন্দু যাওয়ার আরও একটা রাস্তা নাকি আছে। কিন্তু সে রাস্তায় গেলে তিন্দুর আগ পর্যন্ত পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। যেতেও নাকি সন্ধ্যা হবে। শুনেই নাকচ করা হলো তার প্রস্তাব।
এমন সময় মাথায় এলো কাঞ্চন বা পারাও পাড়ার কথা। নীচেই পারাও পাড়া। সেখানে থেকে টোয়াইন খাল ধরে দুস্রি বাজারে গেলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আর দেরি করলাম না। সাথে আর কোনো পানি নেই। প্রায় তেত্রিশ চৌত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পথ চলাই দায়। এবার আমরা সেই বৃক্ষ নিধনের স্থানে এলাম। খনরুই গেলো কাঠুরেদের কাছ থেকে পানির খোঁজে।
কিন্তু সেও ফিরে এলো নিরাশ হয়ে। এখন একমাত্র ভরসা পারাও পাড়া। একমাত্র সেখানে গেলেই পানি পাওয়া যেতে পারে। তার উপর জঙ্গলে ঢাকা অংশটুকু পার হয়ে মাথার উপরে খোলা আকাশে সূর্যটি বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। এমন সময় দেখলাম অনেক নীচ থেকে কাঠের বিশাল এক খণ্ড দিয়ে কয়েকজন কাঠুরে উঠে আসছে। তাদের শরীর থেকে ঘাম ছুটছে বানের পানির মতো। এমন এক দৃশ্য সেই মুহূর্তে অমানবিক ঠেকলো।
পথের পাশে দু’একটি বিশাল গর্জন গাছ। তিন চারজনের পক্ষেও সে গাছের বেড় পাওয়া সম্ভব না। এখন একমাত্র অপেক্ষা পানির। গলা শুকিয়ে পুরো শরীর পানির জন্য হাহাকার করছে। বিশাল এক পাহাড়ি ঢাল নেমে এসে অবশেষে পানির দেখা পেলাম। শুকিয়ে যাওয়া এক ক্যাসকেডে কিছুটা পানি এখনও আছে। এটিই পারাও পাড়ার মানুষদের পানির উৎস।
আকণ্ঠ জলপান যাকে বলে। জুয়েল ভাই ছিলো বেশ পেছনে। সে এসেই ভুল করে পড়ে থাকা আলগা এক কাঠে পা দিয়ে খেলো দাড়াম করে রাম আছাড়। ভাগ্যিস কোমর ভাঙেনি। এদিকে ক্ষিদেও পেয়েছে রাক্ষসের মতো। পারাও পাড়া পৌঁছে খনরুইয়ের বোনের বাড়ি নাপ্পি আর কড়কড়ে ভাত দিয়ে আহার পর্ব অন্য সবাই সমাধা করলেও আমার আর সে ভাগ্য হলো না। খনরুই বললো এরপরের রাস্তা নাকি খুবই সংক্ষিপ্ত। একটু নামলেই খাল।
তা ধরে দুস্রি বাজার। তার উপর বিলাস দার দেখানো দুস্রি বাজারের রসগোল্লার লোভ পথ চলার গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু কিসের কি!! পথ আর ফুরোয় না। নামছি তো নামছি। সেই কোন সকালে দু’টি বিস্কুট আর দুপুরে চকলেট চানাচুর। এখন নামতেও ক্লান্ত লাগছে। খনরুইকে কিছুক্ষণ পরপরই জিজ্ঞেস করছি আর কতদূর। ততবারই তার জবাব এই তো কাছেই। এর উপর আবার মাঝখানে চড়াই উঠতেও হলো কিছুটা।
ক্লান্তির এক পর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়ে খনরুইকে যখন গালি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখন ক্লাইমেক্স। দেখা পেলাম টোয়াইন খালের। আহ! পানি দেখে এতই শান্তি। বিলাস দা তো এক ঝাপ দিলো। আমি পা ডুবিয়ে বসে রইলাম। অনেকক্ষণ পর জুয়েল ভাই আসার পর আবার একসঙ্গে পা বাড়ানো দুস্রি বাজারের পথে। এবার অবশ্য ঝিরি ধরে। কিন্তু সে আরেক জ্বালা।
কিছু জায়গায় কুম পার হতে গিয়ে পাশের খাঁড়া ঝুকিপূর্ণ পাহাড়ি পথে উঠতে হচ্ছে। একে সারাদিনের ক্লান্ত পায়ে পিছলে পানিতে পড়ার ভয় তার উপর আবার টুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। এমন করে দুস্রি বাজারে পৌঁছালাম তখন আটটা বাজে। ছোট্ট পাহাড়ি বাজার পাততাড়ি গুটিয়েছে প্রায়। দু’একটি দোকান খোলা। দেখা পেলাম বাঙালি এক বৃদ্ধের। তিনি শুধু খাওয়ার ব্যবস্থাই না, থাকারও ব্যবস্থা করলেন তার দোকানে।
তারপর আর কি, এক ঘুমে রাত কাবার। পরের দিনের ঘটনা বলতে নৌকায় আলি কদম পৌঁছানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় দুস্রি জিরি ধরে মেনকিউ পাড়া হয়ে আবার ১৩ মাইল যাওয়া। মাত্র দু’দিনের ট্রেক। কিন্তু তাতেই কি ধকল গেলো। তবে শেষ মেষ ১৩ মাইলে লাংরিং দার দোকানে মিষ্টি পাহাড়ি পেপে শেষ ভালো যার সব ভালো তার প্রমাণ রাখলো।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৬
এএ