১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেভিড লিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিরোধী কাহিনী নিয়ে ‘দ্য ব্রিজ ওভার দ্য রিভার কাওয়াই’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। ছবিটির কাহিনী ছিল ফরাসি লেখক পিয়েরে বুলের বই ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’ অবলম্বনে।
ছবিটির শুটিং হয় শ্রীলঙ্কায়। এটি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ৩০তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এ ছবির বাস্তব ঘটনা থেকে নেওয়া চরিত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফিলিপ তুজে মিত্র শক্তির অন্যতম যুদ্ধবন্দি। ১৯৪২ এর শেষের দিক থেকে ১৯৪৩ এ তিনি তখন তাদের সৈনিকদের কমান্ডিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তখন তাদের বার্মায় যাতায়াতের পথ করতে কাঞ্চনাবুরির কাওয়াই নদীর উপর একটি স্টিলের এবং একটি কাঠের সেতু নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়। জাপান সামরিক কর্তৃপক্ষ এই আদেশ দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল থাইল্যান্ড থেকে জাপানি যুদ্ধের সামগ্রী ও অন্যান্য সরবরাহ পরিবহন এবং সৈন্যদের নির্বিঘ্নে বার্মায় যাতায়াতের পথ তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে এই সেতু নির্মাণের পর দু’বছর ব্যবহৃত হয়। এরপর ১৯৪৫ এর জুনে ধ্বংস করা হয়েছিল সেই রেলপথ ও সেতু। সে সময়কার ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিকোলসন এর স্মৃতি সংকলিত করে ১৯৯১ এ আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘দ্য ম্যান বিহাইন্ড দ্য ব্রিজ’।
‘দ্য ব্রিজ ওভার দ্য রিভার কাওয়াই’ ছবিটি ৮টি ক্ষেত্রে একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়ে সাতটি ক্ষেত্রে পুরস্কার পেয়েছিল। জাপানিজ কর্নেল হিসেবে ছবিতে অভিনয় করেন সেসু হেয়াকাওয়া। কাহিনীর শুরুটা এখানে তুলে ধরা হল-
‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিঙ্গাপুরে আত্মসমর্পণের পর ব্রিটিশ সৈন্যদের একটি দলকে পশ্চিম থাইল্যান্ডে জাপানি জেল ক্যাম্পে রাখা হয়। জাপানি সামরিক অথরিটি জেল কমান্ডেন্ট সাইতোকে নির্দেশনা দেয় যে, সকল যুদ্ধবন্দি, যে যেই র্যাংকেরই হোক না কেন, সবাইকে কাওয়াই নদীর ওপর সেতু নির্মাণ কাজে অংশ নিতে হবে। ওই সেতুপথ দিয়েই অতিক্রম করবে নতুন রেলওয়ে লাইন এবং তাতে বার্মা আক্রমণের পথ তৈরি হবে। কাওয়াই নদীটি বার্মা এবং থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরিকে সংযোজিত করবে। ১৯৪২ এর সেসময় কাঞ্চনাবুরি জাপানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বন্দি ব্রিটিশ সৈন্যদের কমান্ডার লে. ক. নিকোলসন ক্যাম্প কমান্ডেন্ট সাইতোকে (জাপানিজ কমান্ডার) মনে করিয়ে দিলেন, জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধবন্দি সেনাদের কায়িক পরিশ্রম থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরদিন সকালের প্যারেডে লে. ক. নিকোলসন তার অনুগতদের আদেশ করলেন, কাজের আদেশ করা হলে তা অমান্য করে তারা যেন তার পেছনে থাকেন। কমান্ডার সাইতো জেনেভা কনভেনশনের কপি দিয়ে নিকোলসনের মাথায়, মুখে আঘাত করে বললেন, “অবাধ্য হলে ফায়ার করা হবে”। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ব্রিটিশ মেডিকেল অফিসার মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। কামান্ডার সাইতোর আদেশে সকল যুদ্ধবন্দিকে সারাদিন উত্তপ্ত রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আর কমান্ডার নিকোলসনকে রাখা হয় একটি লোহার বাক্সে। বন্ধ রাখা হয় পানি ও খাবার। এবারও মেডিকেল অফিসার চেষ্টা করলেন নিকোলসনকে নমনীয় করতে এবং মুক্ত করে আনতে। কিন্তু নিকোলসন আপোস করতে নারাজ। ’
ছবিটির কথা আমি শুনেছি। দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি। জনপ্রিয় এই সিনেমার সূত্র ধরে মৃত রেলওয়ে এবং কাওয়াই নদীর সেতু দেখতে গিয়েছিলাম কাঞ্চনাবুরি।
২০১০ এ ভ্রমণ করেছি থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো। দেখেছি মৃত রেল। প্রত্যক্ষ করেছি সেই সময়কার স্মৃতিবাহী আলোকচিত্র স্থানীয় জাদুঘরে। থাইল্যান্ড থেকে বার্মা যাবার পথে কাওয়াই নদী পার হয়েছি রেলে। অনুধাবন করেছি এই রেলের ইতিহাস। শপিং, কিংবা কাছের একটি দেশ, কিংবা কম ব্যয়বহুল একটি ভ্রমণ হিসেবে অনেকেই থাইল্যান্ড বেছে নেন। ভ্রমন করেন পাতায়া, চিয়াংমাই বা অন্যান্য জায়গা। কিন্তু কাঞ্চনাবুরি ভ্রমণটি বাদ পড়ে যায় তালিকা থেকে। অথচ এই কাঞ্চনাবুরি ইতিহাসের এক নৃশংস ঘটনার স্মৃতি এবং যুদ্ধবন্দি মানুষের কান্নার প্রতিধ্বনি করছে থাইল্যান্ডের এই অঞ্চলে।
এখন উল্লেখ করা যাক ভ্রমণে জানা বার্মা, কাঞ্চনাবুরি, কাওয়াই নদীর সেতু ও অন্যান্য কিছু তথ্য-
বার্মার গুরুত্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিজের অবস্থানগত কারণেই মিত্র ও অক্ষ উভয় শক্তির কাছে বার্মা হয়ে পড়ে প্রয়োজনীয়। এশীয় ভূখণ্ডে ভারত ও চীনের মধ্যখানে দু’পক্ষেরই বার্মার প্রতি ছিল বিশেষ নজর। উল্লেখ্য যে, বার্মা ছিল ব্রিটিশ কলোনি। পার্ল হারবার আক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে থাইল্যান্ডের দখলকৃত এলাকা থেকে জাপান যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন করে। বার্মায় উপর্যুপরি আক্রমণ করে ব্রিটিশদের আন্দামানের দিকে ধাবিত করে। ব্রিটিশদের তেমন প্রস্তুতি না থাকায় তারা পর্যুদস্ত হয়।
কাঞ্চনাবুরি
এটি থাইল্যান্ডের ৭৬টি প্রদেশের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম প্রদেশ। ব্যাংকক থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে ১৯ হাজার ৪৮৩ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে এই প্রদেশ। এর অধিবাসী এখন ৭ লাখ ৩৫ হাজার। প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) সীমান্ত। এটি কাওয়াই নদীর তীরে। কাওয়াই নদীর ব্রিজের অবস্থান এখানেই। এটি বহন করছে মৃতরেল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবর্ষণের মর্মান্তিক বহু স্মৃতি। এখানে আছে ঝরনা, পর্বত, গুহা এবং জাতীয় পার্ক। এরমেধ্য ৭ স্তরের ঝরনা বলে পরিচিত ইরাওয়ান ওয়াটার ফলসের কথা উল্লেখ করা যায়, যেটা এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। আছে তিনটি যুদ্ধ জাদুঘর। দু’টি যুদ্ধসমাধি। জাতীয় জাদুঘর। ঐতিহাসিক পার্ক। থাই এবং চাইনিজ মন্দির। আর সবচেয়ে ঐতিহাসিক স্থাপনা মৃতরেল এবং কাওয়াই সেতু। ব্যাংককের ব্যাংক সাউদার্ন বাস টার্মিনাল থেকে ১৫ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে কাঞ্চনাবুরির উদ্দেশে। তাতে ২-৩ ঘণ্টার পথ। ব্যাংকক খাওসান থেকে মিনিবাস নিয়েও যাওয়া যায়। ব্যাংকক নর্থ রেলওয়ে স্টেশন থেকেও দিনে দু’বার কাঞ্চনাবুরিতে ট্রেন যায়।
কাওয়াই সেতু নির্মাণের নেপথ্যে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাপান ক্রমে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠছে। ১৯৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট শেষবারের মতো আবেদন জানালেন জাপানের সম্রাটকে। আবেদন শান্তির জন্য। কিন্তু জাপান তখন নীরব। ওই সময় আমেরিকার গোপন বার্তা বিশ্লেষণকারী ধারণা করে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো একটি জায়গায় জাপান বড় ধরনের আক্রমণ করতে যাচ্ছে।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপানের যুদ্ধবিমান হঠাৎ করেই আক্রমণ করলো যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে। আমেরিকার নৌ-সেনাদের ওপর হঠাৎ করে শুরু হল এই বোমা বর্ষণ। একইসঙ্গে জাপান সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করলো ব্রিটেন, কানাডা , অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ৮ ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রও জাপান এবং জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল দেশের পার্লমেন্টকে জানান, তারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। এদিকে জাপান তার আক্রমণ দক্ষিণে সম্প্রসারণ করে। ৮ ডিসেম্বরেই অন্যান্য আক্রমণের পাশাপাশি জাপান সৈন্যরা মালয়েশিয়ায় আক্রমণ করে। তারা অনুপ্রবেশ করে ফিলিপাইনে এবং থাইল্যান্ডে। তারপর একের পর এক এ অঞ্চলের দেশগুলোতে ঢুকে পড়ে দৌর্দণ্ড প্রতাপে। পর্যুদস্ত হয় ব্রিটিশ বাহিনী। মিত্রশক্তির ৯ হাজার সৈন্য নিহত হয়। আর বন্দি হয় এক লক্ষ। প্রাণ হারায় প্রায় ১০ হাজার জাপানি সৈন্য।
৮-১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই জাপানি সৈন্যরা স্থলপথে কম্বোডিয়ায় এবং থাইল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে। বিমানবাহিনী প্রবেশ করে ডন মুং এয়ারফিল্ডে। আর সাতটি সমুদ্রযানে থাইল্যান্ডের উপসাগরের হুয়া হিন থেকে পাতালি উপকূলের মধ্য দিয়ে সামনে চলে যায়। জাপানের নৌ আক্রমণ ঠেকাতে ব্রিটিশ নৌযান প্রিন্স অব ওয়েলস এবং রিপালস প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে পাঠানো হয়। সিঙ্গাপুর থেকে যাত্রার পর মালয় যাবার পথে বিমানের আক্রমণে দু’টোই সমুদ্রে ডুবে যায়। মালয় ছিল ব্রিটিশদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। সিঙ্গাপুরে ছিলো শক্তিশালি নৌঘাঁটি। জানুয়ারিতে (১৯৪২) এরাও পর্যুদস্ত হয় জাপানিদের আক্রমণে।
১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে এর মধ্যে জাপানিরা হঠাৎ হামলা চালায় বার্মায়। তাদের হামলায় পরাজিত হয় ব্রিটিশ, আমেরিকান, চাইনিজ, বার্মিজ ইউনিট এবং তারা হটে যায় ভারতে। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাপানিদের নিয়ন্ত্রণে আসে সিঙ্গাপুর। বন্দি হয় ৩৮ হাজার ৪৯৬ জন ব্রিটিশ সৈন্য, ১৮ হাজার ৪৯০ অস্ট্রেলীয় সৈন্য, ৬৭ হাজার ৩৪০ ভারতীয় (ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান) সৈন্য এবং ১৪ হাজার ৩৮২ জন স্বেচ্ছাসেবী।
তার আগে ডিসেম্বরে কম্বোডিয়ার বাতামবাঙ থেকে স্থলপথে থাইল্যান্ড আক্রমণ করে জাপান। একইসঙ্গে আকাশ পথে ডনমুং অবতরণক্ষেত্রে এবং সমুদ্রপথে থাই উপসাগরের উপকূল দিয়ে আক্রমণ চালায়। থাইল্যান্ড মরণপণ যুদ্ধ করে অল্পসময় টিকে থাকে। অবশেষে থাইল্যান্ডের ফিল্ড মার্শাল ফিবুন সংক্রাম কৌশলগত কারণে স্থলপথে যুদ্ধ-বন্ধ ঘোষণা করলে ব্যাপারটি আত্মঘাতী হয়ে পড়ে এবং জাপানিরা আরও উৎসাহের সঙ্গে ঢুকে পড়ে থাইল্যান্ডে। এরপর ২১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। জাপানিরা আধিপত্য বিস্তার করে এ অঞ্চলে। সিঙ্গাপুর থেকে বার্মায় খাবার সরবরাহে চার দিনের সময় লাগে। সময় এবং ব্যয়ের দিক থেকেও একটি সহজতর পথ আবিষ্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু বার্মায় তাদের যাতায়াত, সরবরাহ পরিবহন সমস্যাপূর্ণ হয়ে পড়ে। প্রয়োজন অনুভূত হয় রেল যোগাযোগের। এই রেল কৌশলগত দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুর এবং হ্যানয়কেও সংযুক্ত করবে এই রেলপথ। এই পথ দিয়ে ভারতকেও সংযোগ করা যাবে এবং পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত ছোঁয়া যাবে। বিশাল এক পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে জাপানি সামরিক বাহিনী রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
কাওয়াই সেতু নির্মাণ
পরে নির্মিত হয় কাওয়াই সেতু। এখানে নির্মিত সেতুর একটি লোহার তৈরি এবং অন্যটি কাঠের। দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরা জাভা থেকে লোহা এনে যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে জোর করে এই সেতু বানিয়ে নেয়। এটি থাইল্যান্ডে এবং বার্মার সংযোগকারী রেলপথ সংযোগকারী সেতু। এই সেতুটি পার হতে এখনও রেলে যেতে হয়। ঐতিহাসিক ঘটনাকে ধরে রাখতেই এটি বজায় রাখা হয়েছে। ব্রিজের এপারে কাঞ্চনবুরি ও অন্যপারে নামতক স্টেশন। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এই রেলে ভ্রমণ করে ব্রিজ অতিক্রম।
মৃতরেল
বার্মা এবং থাইল্যান্ডকে সংযুক্ত করার জন্য রেলপথ করার জাপানি পরিকল্পনাটি নতুন ছিল না। একই দশকে ব্রিটিশও এই রেলরুটের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করেছিল। কিন্তু পরিকল্পনাটি ততটা বাস্তবসম্মত নয় মনে করে এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে তারা। কিন্তু জাপানিরা কাজটি অনেক ব্যয়বহুল হলেও আমেরিকার পার্ল হারবারে বোমা ফেলার পর তাদের আত্ববিশ্বাস বেড়ে যায়। এই আক্রমণের পরবর্তী বিজয় ধরে রাখার জন্য কাজের ব্যয় তাদের সামনে আর মুখ্য বিষয় থাকেনি। অনেক ব্যয়বহুল হলেও তারা কাওয়াই সেতুর নির্মাণসহ রেলপথ নির্মাণকে গুরুত্ব দিতে থাকে।
১৯৪২ সালে এ সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে জাপান সামরিক বাহিনী। জুনে জাপানি সৈন্যের রাজকীয় কমান্ড এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করে। আদেশে বলা হয় রেল লাইনটি হবে এক মিটার গজ বিশিষ্ট। পাদুক থেকে লাইনটি কাঞ্চনাবুরি হয়ে নামতক এবং এর পর কাওয়াই নদী পার হয়ে বার্মার সীমান্তে খাওয়া নোই নদী অতিক্রম করবে। তিনটি প্যাগোডা পথে ফেলে উত্তর-পশ্চিম বার্মার উপকূলে থামবায়ুজায়াত হয়ে রেংগুনগামী পুরনো রেললাইনের সঙ্গে সংযোজিত হবে এটি। জাপান জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে যুদ্ধবন্দিদের শ্রমে এই রেলওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। অমানবিক এবং অমানুষিক নির্যাতনের এক নজিরবিহীন রূপ ছিল এটি। প্রচণ্ড চাপের মুখে এই যুদ্ধবন্দিরা শারীরিক পরিশ্রম করে জাপানিদের ইচ্ছায় নির্মাণ করে রেলওয়ে লাইন।
এর কষ্টসাধ্য কাজে সম্পৃক্ত হয় ৬১ হাজার ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয়, নিউজিল্যান্ডার, ড্যানিশ এবং ডাচ বন্দি সৈন্য। ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বার্মা এবং থাইল্যান্ড থেকে জোর করে নিয়ে আসা আনুমানিক ২ লাখ শ্রমিক। এরা জাপানি সৈনিকদের শাস্তির ভয়ে যোগ দিয়েছিল ব্রিজ নির্মাণ কাজে। রেলপথটি ৪১৫ কিলোমিটার। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে এটি সংযুক্ত করবে কাঞ্চনাবুরি ও বার্মার থানবুয়িজায়াতকে, যেখানে আছে জাপানি ক্যাম্প। এতে সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড হয়ে বার্মায় সংযোগ স্থাপিত হবে। বার্মায় সৈন্যদলের যোগাযোগ, যুদ্ধ সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করা এই রেল স্থাপনের উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে জাপানিদের পরিকল্পনা ছিল এই রেলপথে ব্রিটিশ-ভারত আক্রমণ করা।
১৯৪৩ এর আগস্টে এই রেলওয়ের নির্মাণ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা হয়। আর এই রেলের কাজের জন্য বন্দিদের বার্মা এবং থাইল্যান্ডে পাঠানো হয় ১৯৪২ সালের জুনে। নির্মাণ শুরু হয় ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে। জাপানিদের প্রথম প্রাক্কলনে বলা হয়, এই রেল স্থাপনে ৫ বছর সময় লাগবে। কিন্তু অসহনীয় চাপের ফলে ১২ মাসের মধ্যে এই রেল স্থাপনে বন্দিদের বাধ্য করানো হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরো রেলওয়ে সরিয়ে ফেলা হয়। একদিকে এই পথ নিয়ে নিরাপত্তার প্রশ্ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণেও এর অবস্থান ছিল নৈতিকতার বাইরে। কারণ এই রেলে জড়িয়ে ছিল শত শত বন্দি সেনার কষ্টের কান্না।
কেন মৃত রেলওয়ে
রেলপথ নির্মাণের দুঃসহ এই কাজের চাপে মিত্র শক্তির ১৬ হাজার সৈন্য জীবন হারায়। ধারণা করা হয় যে, এশীয় শ্রমিকদেরও ১ লাখ জীবন হারিয়েছে যাদের তথ্য বরাবরই আড়াল করে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক ভারতীয় ও চীনা নাগরিকও ছিল। জীবন বাজি রেখে কাঠের স্লিপার বসাতে গিয়ে প্রতি কিলোমিটারে অন্ততঃ ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি ছিলো একটি কৌশলগত রেলপথ যার ২৬৩ কিলোমিটার থাইল্যান্ডে এবং ১৫২ কিলোমিটার বার্মায়। পরে থাই এবং বার্মিজ যৌথ সিদ্ধান্তে তারা তাদের কমন বর্ডার থেকে এবং প্রত্যেকের এলাকায় ১০০ কিলোমিটার ধ্বংস করে ফেলে। যারা এই ডেথ রেল তৈরি করেছে তাদের কেউই এই রেলে চড়েনি।
কাওয়াই ব্রিজ উৎসব
২৫ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর প্রতিবছর পালিত হয় কাওয়াই নদী ব্রিজ উৎসব। আয়োজন করা হয় সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো। এ উৎসব পর্যটকদের মনে করিয়ে দেয় মৃত্যু রেল, হেলফায়ার পাস এবং ব্রিজের ইতিহাস। মনে করিয়ে দেয় একসময় যুদ্ধবন্দিদের হাতে নির্মিত ৪১৫ কিলোমিটার এই মৃত রেলের কথা।
হেলফায়ার পাস
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাহাড় কেটে একটি পথ তৈরি করেছিল অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের বন্দি সৈন্যরা। পাহাড়ের শিলা পাথর কেটে ৭৩ মিটার দীর্ঘ ও ২৫ মিটার উুঁচু এ পথ সম্পূর্ণ হাতে কেটে বানিয়েছিল তারা। ১৯৪৩ এর এপ্রিলে শুরু করে ৩ মাস কাজ করে বানানো হয়েছিল এটি। আরেকটি কাটা পথ আছে যার দৈর্ঘ্য ৪৫০ মিটার। যুদ্ধ বন্দিদের দিয়ে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করিয়ে বানানো হয়েছিল হেলিফায়ার। এখানে রাতের বেলা জ্বালানো হতো কার্বাইড ল্যাম্প, বাঁশ পোড়া আগুন এবং টর্চ। কাটা পাথরের গায়ে আলো ছায়ার খেলার কারণেই এর নাম হয়েছে হেলিফায়ার।
এই কাটা পথের শিলা কাটতে ছিলো না কোনো মেশিন। কাজটিতে ব্যবহার হয়েছে ৩ হাজার ৫ কেজি হাতুড়ি, স্টিল ড্রিল ইত্যাদি। কাজের সময় অন্তত ৬৩ জন যুদ্ধ বন্দিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। অনেকেই ক্ষুধা, পেটের পীড়া এবং কলেরায় মারা গেছে।
ওয়ার সিমেট্রি
কাঞ্চনাবুরিতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে হাতের বাঁয়ে পড়বে ইডেন গার্ডেন। এখানে সবুজের সমারোহ, ফুলের ঘ্রাণ আর সতেজ বাতাসের ঝিরিঝিরি। তাতে যেনো মূর্ত হয়ে উঠছে দুঃখ, কষ্ট এবং বেদনার আবেদন। এখানে যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতি বয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পাথর। এরকম আরও দু’টো সিমেট্রি আছে এখানে। কমনওয়েলথ গ্রেইভ কমিশন এই সিমেট্রিগুলো সযত্নে দেখাশোনা করছে। জাপানিরা রেলওয়ে নির্মাণে সময় পথে পথে জঙ্গলে নিহত যুদ্ধবন্দিদের পুতে রেখেছিল, তাদের অস্তিত্ব খুঁজে বের করে সিমেট্রিগুলোতে স্থানান্তর করা হয়েছে। থাইল্যান্ডের প্রধান সিমেট্রি কাঞ্চনাবুরি থেকে চার কিলোমিটার দূরে সাংচুতো রোডে। সেখানে আছে ৬ হাজার ৯৮২টি মরদেহ।
যুদ্ধবন্দিদের ওপর এরূপ নির্যাতন এবং হাজার হাজার বন্দির জীবনাবসানের শোকগাঁথা ইতিহাস নিয়ে কাঞ্চনাবুরি প্রতিদিন অপেক্ষা করে পর্যটকদের জন্য। পর্যটকদের জন্য রাখে অমূর্ত বাণী, ‘আর যুদ্ধ নয় পৃথিবীতে। কখনও নয়। বন্ধ হোক মানুষের ওপর মানুষের অমানবিক অনাচার ও অত্যাচার। ’
লেখক: ফারুক হোসেন
বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৬