নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে: ছোঁয়াখালী ব্রিজ; মনোরম নিঝুম দ্বীপের লম্বা রাস্তা ধরে যেতে যেতে পর্যটককে যেখানে একবার থামতেই হবে। রাস্তার দুপাশে সবুজ বন আর বনের ফাঁকে ফাঁকে মায়াবী হরিণ ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যের শুরু তো সেখান থেকেই।
তবে নিঝুম দ্বীপবাসীর কাছে এখান থেকেই সীমানা ভাগ করা। যে সীমানা প্রশাসনিকভাবে নয়- নির্ধারিত হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মাধ্যমে।
গত মার্চের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে কার্যত দুইভাগে ভাগ হয়ে আছে নিঝুম দ্বীপ। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে ঘুম হারাম এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষের।
নোয়াখালী জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছন্ন নিঃশব্দের এ দ্বীপ এখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জ্বলছে। যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না মানুষ থেকে নিরাপরাধ গবাদিপশুও।
মূলত গত ২২ মার্চের ইউপি নির্বাচনের পর প্রতিহিংসার এ রাজনীতি আরও চরম আকার ধারণ করে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেলো ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন। জয়ও পান বিপুল ভোটে। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা কোনোভাবেই তাকে মেনে নিতে পারেননি, পারছেনও না। স্থানীয় কর্মীদের সমর্থন আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিঝুম দ্বীপ জুনিয়র স্কুলের শিক্ষক সাইফুল ইসলামের প্রতি। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থনও পান তিনি।
এতে নির্বাচনের পর থেকে শুরু হওয়া দুই গ্রুপের সংঘর্ষ আজও চলছে। নির্বাচনে মেহরাজ উদ্দিন জয়লাভ করলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ, কেন্দ্র দখল করেই জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন মেহরাজ। ছোঁয়াখালী ব্রিজের উত্তরপাশ মেহরাজের এবং আরেকপাশ সাইফুলের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। দক্ষিণপাশ থেকে সাইফুলের কর্মী উত্তরপাশে গেলেই চেয়ারম্যানের লোকজন তাদের আহত করেন। মোটরসাইকেল কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
মেহরাজ বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন অভিযোগ এনে সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দ্বীপের সাধারণ মানুষ তাকে ত্যাগ করেছেন। আর সে ক্ষোভেই জোর করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছেন মেহরাজ। প্রতিদিন কেউ না কেউ তার ডাকাতদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
জানা যায়, নির্বাচনে মেহরাজের পক্ষ না নেওয়ায় জয়ী হয়েও স্থানীয় চার ইউপি মেম্বরকে (সদস্য) মেহরাজের ভয়ে কয়েকমাস এলাকার বাইরে থাকতে হয়েছে। প্রায় চারমাস পরে ভিন্ন পথে নিজ গ্রামে ফিরলেও ছোঁয়াখালী ব্রিজের উত্তরপাশে যেতে পারেন না তারা। যেটি মেহরাজের এলাকা হিসেবে পরিচিত।
যাদের একজন নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বর কেফায়েত উল্লাহ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যানের অনেক বাধার পরও জনগণের ভোটে আমি নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু জয়ী হয়েই নির্বাসিত হতে হয়। এখন ফিরলেও সারক্ষণ জীবন শঙ্কায় থাকতে হচ্ছে।
নির্বাসিত অন্য ইউপি সদস্যরা হলেন- ১নং ওয়ার্ডের খবির উদ্দিন রাজু, ৩নং ওয়ার্ডের আবদুল আজিজ ও ৪নং ওয়ার্ডের নিজাম উদ্দিন।
নিজাম উদ্দিনের অভিযোগ, নির্বাচিত হয়েও ইউনিয়ন পরিষদে গেলে চেয়ারম্যানের লোকজন ধাওয়া করেন।
কেফায়েত উল্লাহ বলেন, গেলো প্রাকৃতিক দুর্যোগে (রোয়ানু) আমার ওয়ার্ডের লোকজনের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হলেও চেয়ারম্যান তাদের একটা দানাও দেননি। অমানবিক কষ্ট করেছেন মানুষজন।
বন্দরটিলা এলাকার বাজারে মেহরাজ চেয়ারম্যানের বিশাল মার্কেট
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, মেহরাজ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গোটা দ্বীপ চাঁদাবাজিতে অসহায়। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় মরতে হয়েছে মো. শামছুদ্দিন নামে একজনকে। এছাড়া পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে আরও অনেককে।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, নিঝুম দ্বীপে সনাতনী কায়দায় সন্ত্রাস চালানো হয়। এছাড়া মেহরাজ চেয়ারম্যান অবৈধভাবে বন ধ্বংস করে জায়গা-জমি দখল করেন।
এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুবু মোর্শেদ লিটন বাংলানিউজকে বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি- নিঝুম দ্বীপে এমন একজন সরকার দলের প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন- যে প্রকৃত পক্ষে একজন ডাকাত। যার কারণে শান্ত নিঝুম দ্বীপ এখন অশান্ত। দুই ভাগে বিভক্ত।
এ বিষয়ে ঘরছাড়া আরিফ গোয়াল টেলিফোনে বাংলানিউজকে বলেন, মেহরাজকে সমর্থন না করার অপরাধে আমি ঘরছাড়া, আমার পরিবারও অনিরাপত্তায় ভুগছে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান মেহরাজ বাংলানিউজকে বলেন, আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। প্রতিপক্ষ ব্যালটে না জিতে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসব অভিযোগের কোনটিই সত্য নয়।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাইফুলের বিরুদ্ধে নিজ দলের লোকজনদের নিপীড়ত হওয়ার অভিযোগ তোলেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৬
জেপি/আইএ