বান্দরবান ঘুরে: দুপুরের রোদ এসে পড়েছে ঝিরির জলে। চারপাশে প্রচুর ভাঙা ডাল-পালা, আলগা পলি জমা পাড় আর এখানে-সেখানে পাহাড় ধস দেখে বোঝা গেলো গত কয়েকদিন এখানে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে।
ট্রেইল এক অদ্ভুত জায়গা। আপনি আসুরিক শক্তি নিয়ে হেঁটে কোনো দিকে না তাকিয়ে পার হয়ে যেতে পারেন। আবার একটু পর পর থেমে শুনতে পারেন অচীন পাখির গান। আমি অবশ্য প্রথম দলের মানুষ। কিন্তু আমাদের দলের প্রায় সবাই জাত রোমান্টিক। পাখির ডাক, প্রজাপতি, অচেনা ফুলের আহ্বান তারা ফেলতে পারেন না। একটু দাঁড়ানো না হোক নিদেনপক্ষে ক্যামেরার একটা ক্লিক করা চাই-ই। তাই আমাকেও থামতে হচ্ছে।
ঝিরির পাশে পাথরের গায়ে একটি গ্রিন ভাইপার সাপ ফনা তোলার ভঙ্গিতে বসে আছে। তার আহ্বান ফেলতে পারলাম না। কিন্তু কাছে গিয়েই এক দুঃখজনক দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হলো। সাপটির মাথা কেউ ধারালো অস্ত্র নিয়ে কেটে ফেলেছে। সাপটি সে অবস্থায়ই পড়ে আছে। সাপ কখনো নিজে থেকে আক্রমণ করে না। তার অবস্থান ছিলো চলার পথ থেকে অনেকটা দূরে। তাই যারা কাজটি করেছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই নৃশংস এ ঘটনা ঘটিয়েছে সেটা স্পষ্ট।
এক সময় ঝিরি পথ শেষ হলো। এবার উপরে ওঠার পালা। আস্তে আস্তে এখন কিন্তু শুধু উপরের দিকেই উঠতে হবে। মধ্য শ্রাবণের রোদজ্বলা দুপুরে উঠতে শুরু করতেই মনে হলো কাজটি সহজ হবে না। ক্রমেই দল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম। অনেক দূরে গিয়ে দাঁড়াই, এর মধ্যে পুরো দল আবার একত্রিত হই। আবার পথ চলি। এই নিয়মেই চলতে লাগলো রনিন পাড়ার দিকে আমাদের কাফেলা।
এক সময় পথ থেকে দিগন্তের দিকে কেউ একজন হাত তুলে দেখালো সিপ্পির চূড়া। এই রেঞ্জের সর্বোচ্চ চূড়া হচ্ছে সিপ্পি। রনিন পাড়ার দিকে যতই এগোবেন এই পথ ধরে, ততই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলবে সব চূড়া ছাপিয়ে ওঠা সিপ্পি। আমরা একটি বিকল্প পথ ব্যবহার করছি। রনিন পাড়া যাওয়ার জন্য এখন পাহাড় কেটে গাড়ি চলার উপযোগী প্রশস্ত রাস্তাও করা হয়েছে। সময় বাঁচাতে কিছুটা অন্য রাস্তা ব্যবহার করছি।
এক জায়গায় পানি পানের বিরতি দেওয়া হলো। আক্ষরিক অর্থেই সেখানে বসলে ঘুম চলে আসবে। ঝিরি ঝিরি দখিনা বাতাস বইছে। গাছের ছায়ায় ফিল্টার হয়ে আসা রোদের রেখার ঝাঁঝ অনেকখানি কমে গেছে। সেই রোদ পড়েছে আমাদের শরীরে। সামনে জুমের ফসলের সবুজে একাকার পুরো পাহাড়ি উপত্যাকা। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি চাষিদের টংঘর। আজ আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।
একদম রোম্যান্টিক করে দিতে চাইবে। কিন্তু হওয়া যাবে না। অনেকখানি পথ যে পাড়ি দিতে হবে। এবার এক টানা হাঁটতে লাগলাম। রাস্তা ক্রমশ উঁচুতে উঠছে। আমাদেরও হাঁটার বিরাম নেই। একটানা হেঁটে কেপল্যাং পাড়ার কাছে এক চা দোকানে বিরতি দিয়ে আবার চলা।
রোয়াংছড়ি থেকে তিন ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাইক্ষং পাড়া। দিন শেষ হচ্ছে। রোদ মরে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু গরম ঠিকই আছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। সেখানে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার চলা শুরু করলাম। এবার আর কোনো থামাথামি নেই। ট্রেকের প্রথম ধাক্কা সামলে শরীর পুরো মানিয়ে নিয়েছে। সন্ধ্যার মুখে গিয়ে থামলাম প্রশস্ত রাস্তা শেষ হয়েছে যে উৎরাইয়ের মুখে গিয়ে। দারুণ সুন্দর একটি চালাঘর আছে সেখানে।
বাতাস বইছে জোরছে। সঙ্গীরা তখনো বেশ দূরে। ভর সন্ধ্যায় বাতাসে চালের আলগা টিনে শব্দ হচ্ছে। ভূতের ভয় যে একেবারেই লাগেনি সে দাবি করবো না। সেই ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে সবাই এলো চল্লিশ মিনিট পর। এরপর সারা দিনের ট্রেকে ক্লান্ত শরীরকে টেনে হিঁচড়ে প্রথম সেনা ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট, সেখানকার উষ্ণ অভ্যর্থনা অতঃপর পাড়ায় গিয়ে ঢালা বিছানায় গা এগিয়ে দেওয়া।
চলবে....
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৬
এএ