বান্দরবান ঘুরে: আজ বাকেট লিস্ট লম্বা। গত দু’দিনের বড় লক্ষ্যগুলো ভালোভাবেই পূরণ হয়েছে।
এ কথা শুনে আবার সবাই গা এলিয়ে দিলো। ছোট লক্ষ্য দেখে আর কেউ গা করছে না। রোদও উঠেছে বেশ তেঁতে। শেষ পর্যন্ত গাইগুই করতে করতে সবাই যখন ট্রেইলে নামলো ততক্ষণে দশটার বেশি বাজে। প্রথমে ঠিক করা হলো মাঙসন সাইতার যাওয়ার। ট্রেকের প্রথম এক ঘণ্টাকে বলা হয় সবচেয়ে কষ্টের। তার মানে মাঙসন সাইতার পর্যন্ত যেতে কষ্ট পেতে হবে। হলোও তাই।
চড়া রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বিশাল খাড়াইয়ের মুখে দাঁড়িয়ে নিচের ট্রেইল দেখে তো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। রাস্তা অন্তত আশি ডিগ্রি খাঁড়া। নামার সময় স্যান্ডেলে পা রাখা যাচ্ছে না। তার উপর কাঁধের ব্যাগ প্যাক। এর মধ্যে হলো আরেক কাণ্ড। জুয়েল ভাই আর নাফিজা আপা আমাদের সঙ্গে নেই। তাদের জন্য পথে চিহ্ন রেখে আসা হয়েছিলো। এক সময় ভয়ংকর উৎরাইটুকু শেষ হলো। ঝরনা এখান থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ। এর চেহারা দেখে একটু হতাশই হলাম। ঠিক আগের দিন তিনাপ সাইতারের যে রূপ দেখেছি তার তুলনায় এটি নাকি ছোট নালার মতো, বাকিদের অভিমত এমনই।
কিন্তু ঝরনা ধারা সে যতই ছোট হোক তার একটি স্বতন্ত্র রূপ বৈচিত্র্য থাকবেই। প্রায় সত্তর, আশি ফুট উপর থেকে পড়া জল ধরার গতি বেশ। নিচে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। পুরো উপত্যাকার মতো জায়গাটি উপরের চেয়ে বেশ শীতল। সবাই ঝাপাঝাপিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার কেন জানি ঝাপাতে ইচ্ছে করলো না। এখানে বেশিক্ষণ থাকার কোনো মানে হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে মেনে উঠতে হলো।
সেই ভয়ংকর খাড়া চড়াই পার হয়ে যখন ট্রেইল ধরে যাচ্ছি তখন দেখি জুয়েল থিওটোনিয়াস আর নাফিজা দৌলা পথ খুঁজে কেবল নামছেন। তারা নাকি মূল রাস্তা থেকে বহুদূর চলে গিয়েছিলেন। এখন আবার এই ভয়ংকর চড়াই ধরে নেমে ঝরনার কাছে যেতে হবে। আমরা আর দাঁড়ালাম না। চলে এলাম পাড়ায়।
রনিন পাড়ায় সবাই একত্রিত হয়ে এবার চললাম তিদংখদ ঝরনার দিকে। এটি যেতেও এক ঘণ্টার বেশি লাগে না। কিন্তু মানুষ চলাচল নেই বলে কিছু রাস্তা একেবারেই বুনো। পাহাড়ের একেবারে ঢাল ঘেঁষে চিলতে মতো রাস্তা নেমেছে ঝিরিতে। বৃষ্টি হলে এ রাস্তা বিপদজনক। ঝিরিতে নেমে পিচ্ছিল বোল্ডারগুলো মাড়িয়ে চলেছি ঝরনার পানে।
পাহাড়ি ঝিরির কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকে। বিশেষ করে যেসব ঝিরিতে মানুষের চলাচল কম সেগুলোর পরিবেশ সত্যিই গা ছমছমে। এ ঝিরিটির দু’পাশের পাহাড় থেকে ঝোপঝাড় এমনভাবে চেপে ধরেছে উপরে আকাশ পর্যন্ত দেখা যায় না। ভর দুপুরেও সন্ধ্যার আবহ। এক সময় তিদংখদ আমাদের তার দর্শন দিলো। মাঙসন সাইতার দিনের প্রথম ভাগে আশাহত করেছিলো তার সবটুকুই পুষিয়ে দিলো তিদংখদ।
পাহাড়ি খাঁজ থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি কেটে নেমে এসেছে জলের ধারা। দু’দিন বেশি বৃষ্টি হয়নি বলে পানি বেশ কম। কিন্তু এর গঠনটিই মুগ্ধ করে দিতে যথেষ্ট। ঝরনার বিপরীতে উপরের পাহাড়টি ঈষৎ ঝুঁকে গুহার মতো গঠন তৈরি করেছে। এই বুঝি ভ্যাম্পায়ার বেরিয়ে এলো। এখন যদি ঝুম বৃষ্টি নামে তবে অ্যাডভেঞ্চারের ষোলকলা পূর্ণ হয়। এক কথায় তিদংখদ একশোতে একশো। আমার এ যাবত দেখা সুন্দরতম ঝরনাগুলোর তালিকায় এটি সহজেই ঢুকে যাবে।
যতই মুগ্ধতার আবেশ জড়িয়ে থাকুক ফেরার টান কিন্তু এর থেকেও বেশি। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর আবার ফিরতি পথ ধরলাম। পাড়ায় ফিরে সিদ্ধান্ত হলো রিজার্ভ সাইতার এ যাত্রায় আর না দেখলেও চলবে। মাঠে পাহাড়ি শিশুদের সঙ্গে সবাই মাতলো ফুটবলে। আমার সুখ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বসে খেলা দেখেই। রাতে অনেক নাটকের পর হলো মহাভোজের আয়োজন।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেরার তোড়জোড়। কম না রাস্তা। আজ কিন্তু ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু আমাদের বিরাম দিলে চলবে না। অফিসে এরই মধ্যে একদিন কামাই গেছে। আরেক দিন মিস হলে মুণ্ডু কাটা যাবে। পাহাড় আর এ মানুষগুলোর টানেই আসি। আসবো বারবার।
বাংলাদেশ সময়: ০১০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬
এএ