শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): রাতের কালো আঁধার ঘুচিয়ে জেগেছে প্রথম সকাল! চারদিকে ভোরের শুদ্ধতা আর সজীবতা। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ উপজেলার পাকা সড়ক।
সকালের শ্রীমঙ্গলটা কী সুন্দর! প্রথম সকালের এমন স্নিগ্ধ প্রকৃতি দেখা হয় না আমাদের অনেকেরই। তাই নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার অভিপ্রায়ে প্রভাতসবুজে বের হওয়া।
প্রহরে প্রথমেই স্বাগত জানালো ঠেলাগাড়ির চালক। একজন অথবা দু’-চারজন করে করে ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। বহু দূর থেকে আনারস-লেবু-কলার ছড়ি ঠেলাগাড়িতে করে বয়ে নিয়ে আসছিল। এ যেন বেঁচে থাকার কঠিন প্রেরণার মহড়া!
তাদের যাত্রা বিরতি করিয়ে দিতে মন চাইছিল না, তবু করালাম! তাদের নাম মুর্শেদ, আনোয়ার, এনামুল আর সবুজ। প্রতিদিন ভোর চারটায় তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। এই কর্মযজ্ঞের প্রবাহমান ধারা চলতে থাকে বিকেল পাঁচটা অবধি। আসলে, আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব জীবনের একেকজন একেক জায়গার ঠেলাগাড়ি চালক!
সামনে এগোতেই পেয়ে গেলাম এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে। তার নাম শামীম আহমেদ। শহর থেকে তিন-চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন সকালে সবুজের স্রোতে মাখামাখি হতে আসেন।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় চাকরি করেছি। কিন্তু শ্রীমঙ্গলের মতো সৌন্দর্য আর শাস্তি কোথাও পাইনি।
কথা শেষ হতে না হতেই স্থানীয় ইকো-ট্যুর গাইড চন্দ্রশেখর এসে হাজির। সে অনুমতি ছাড়াই আমাদের কথায় প্রবেশ করলো। তাতে বিস্ময় ভাবটা কেটে গেল তার আন্তরিকতার স্পর্শে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মাত্রাতিরিক্ত পর্যটক সম্পর্কে চন্দ্রশেখরের স্পষ্ট বক্তব্য, লাউয়াছড়ায় যে পর্যটকরা আসেন তাদের অনেকেরই প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাই নেই। তারা নিঃশব্দের প্রকৃতি দেখার বিপরীতে বনের নির্জন পরিবেশ ধ্বংস করে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করেন।
আরেকটি শঙ্কার কথা উল্লেখ তিনি বলেন, লাউয়াছড়া ও এর চারপাশের বন ধীরে ধীরে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ার ফলে বন্যপ্রাণীরা আজ বন থেকে লোকালয়ে এসে মারাত্মক বিপদের মুখে পড়ছে। এগুলো সম্পর্কে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ততক্ষণে প্রকৃতিতে মৃদু কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। দূরের গাছপাতায় যেন ধোঁয়াটে রঙে রূপান্তরিত। কুয়াশার এমন উপস্থিতি শীতের কথাই মনে করিয়ে দেয় স্বাভাবিকতার স্বরে।
তারপরের গন্তব্য লাইয়াছড়ায়। প্রিয় লাউয়াছড়া। লাউয়াছড়ার শুধু সকালটা নয়, প্রতিটা মুহূর্ত কেমন বর্ণ-গন্ধময় অথবা বিচিত্রতার আপন রঙে রাঙা তা দেখার ইচ্ছে কখনোই পুরনো হয় না।
এই লাউয়াছড়াকে ‘এখনো খনি’ এই বিশেষ শব্দ দু’টি দিয়ে সারা জীবনের আকর্ষণ বাড়িয়ে রেখেছেন বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী শ্রদ্ধাভাজনেষু তানিয়া আপা (তানিয়া খান)।
চন্দ্রশেখর যাত্রাসঙ্গী হতে রাজি। আমাদের দু’জনের মোটরবাইক অসমান দূরত্বের গতি বাড়িয়ে লাউয়াছড়ায় গিয়ে পৌঁছালো।
দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা সিএনজি অটোরিকশাসহ নানা যানবাহনগুলো লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণীর জন্য আরেক প্রকারের ঝুঁকি আর আতংক- এ কথাটা আবারও প্রমাণিত হলো চোখের সামনে।
স্থানীয় বনপ্রহরী শফিক কুশল বিনিময়ের জন্য এগিয়ে এলেন। সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা ও অল্পক্ষণ পায়ে হেঁটে বন পর্যবেক্ষণের স্বাদ গ্রহণের কথা জানালে তিনি জানকিছড়া বিটে নিয়ে গেলেন।
আশ্চর্য! লাউয়াছড়া আসতে চারপাশটা যতটা কুশায়াঢাকা ছিল, লাউয়াছড়ার ভিতরটাতে তা নেই। বরং সূর্য উঠেছে খিলখিল করে! মনে পড়ে গেলো অপূর্ব রবীন্দ্র চরণটি – ‘আলোকেই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও; আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা, ধুলারঢাকা ধুইয়ে দাও। ’
নাম না জানা নানা প্রজাতির লতাগুল্মের পরশ টের পাচ্ছি পায়ে! উফফ! কী দারুণ অনুভূতি! ওরা যেন আমাকে ধরে রাখতে চাইছে বারবার। ওদের গায়ে গায়ে ছড়ানো কুয়াশাকণা! যা সারারাতের সঞ্চিত জলজ অর্জন। শীত এভাবেই তার সমস্ত বিন্দু বিন্দু সজীবতা দিয়ে প্রকৃতিকে সতেজ করে রাখে।
হঠাৎ চোখে পড়লো মাকড়সার জাল! শুধু জাল নয়! ক্ষুধার্ত মাকড়সাটি তার শিকার ধরে একটু একটু করে খাচ্ছে! শফিক বললেন, দেখেন, সূর্যের আলোয় মাকড়শার জালটি কেমন অপূর্ব দেখাচ্ছে!
প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ, এ দৃশ্যপটটির আবেদন প্রচণ্ডভাবে মুগ্ধ করে রেখেছিল। মনে মনে বললাম, সত্যিই তাই!
ফিরে আসার সময় প্রিয় লাউয়াছড়ার প্রকৃতিকে বললাম, এমন একটি সার্থক সকাল কত বছরের যে প্রতীক্ষা ছিল!
পর্যটকরা শ্রীমঙ্গলে এলে কষ্ট হলেও ঘুমের আড়মোড় ভেঙে ভোরের অপরূপ শ্রীমঙ্গল দেখে নিতে পারেন। তাতে কেটে যাবে সমস্ত দিনের ক্লান্তি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬
বিবিবি/এএ