আগরতলা (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে: আগরতলায় এসে পাল্টে গেছে বাংলাদেশি পণ্যগুলোর বিজ্ঞাপনচিত্রের চরিত্র। স্থানীয় মডেলের শরীরে চড়েছে ভারতীয় পোশাক।
হাওড়া নদীতীরের প্রধান বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে বিশাল এক বিল বোর্ডে আরএফএল এর বালতির বিজ্ঞাপন। নানা রঙা বালতির পাশে তাতে লেখা ‘এ যুগের দুর্গাদের দরকারে, এ যুগের দুর্গাদের সংসারে। ’ পাশে এক টিনএজার নববধূর হাস্যোজ্বল ছবি। প্রাণের বিজ্ঞাপনে লেখা ‘প্রাণের পূজো, পূজোর প্রাণ’।
সামনে পূজা বলেই এখন সরগরম পুরো আগরতলা শহর। সিটি সেন্টার, এইচ জি বি রোড, ওরিয়েন্ট চৌমুহনীতে কেনাকাটার উৎসব। স্থায়ী দোকানগুলোর সামনে রাস্তার দু’দিকেই ফুটপাতের ওপরও বিকিকিনি জমজমাট।
চৌমুহনীর ঐতিহাসিক কামান আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ট্যাংকের চারপাশে রঙিন আলোর খেলা। ১৯৭১ সালে ওই ট্যাংক নিয়ে পাকি হানাদারদের ওপরে চড়াও হয়েছিলো মিত্র বাহিনী। ত্রিপুরাবাসী যুদ্ধজয়ের গৌরবমাথা সেই ট্যাংক সযতনে সাজিয়ে রেখেছে চার রাস্তার গোলাকার সড়ক দ্বীপে।
পাশেই মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতার স্মৃতি বইছে সাদা রঙের কংগ্রেস ভবন।
আকাশ ছোঁয়া হাউরাইজের আগ্রাসন এখনো শুরু হয়নি আগরতলায়। একটু পরপরই চার রাস্তার মোড়। চৌমুহনী কথাটা তাই জুড়ে আছে সব নামের সঙ্গে। যে মোড়ে কামান আছে তার নাম যেমন কামান চৌমুহনী, তেমনি খাল পাড়ের মোড়ের নাম লেক চৌমুহনী। আরো আছে বিজয় কুমার চৌমুহনী, ওরিয়েন্ট চৌমুহনী, পোস্ট অফিস চৌমুহনী ইত্যাদি নাম। প্রতিটি চৌমুহনীর ঠিক মাঝখানে একটি করে ট্রাফিক আইল্যান্ড। ছোট্ট আইল্যান্ডগুলোতে একজন করে মানুষ দাঁড়াতে পারে কেবল। সাদা পোশাকের ট্রাফিকের হাতে বাংলাদেশের মতো লাঠি তো দূরের কথা, বাঁশিও নেই। আছে কেবল স্টপ লেখা চাতকির মতো একটা পাত। সেটি বাড়িয়ে ধরলেই থেমে যাচ্ছে সব গাড়ি। সরিয়ে নিলে চলতে শুরু করছে ফের। এমন সুশৃঙ্খল সিস্টেমে বোধ করি সিগন্যাল বাতিরও প্রয়োজন পড়ে না, নেইও।
উমাকান্ত একাডেমি থেকে দূরদর্শনের ত্রিপুরা কেন্দ্র পর্যন্ত ফ্লাইওভার হচ্ছে আগরতলায়। ২.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ত্রিপুরার প্রথম এই ফ্লাইওভার মূলত চলাচল সহজ করে দেবে ভারতের ৪৪ নম্বর জাতীয় মহাসড়কে। ভিড়-ভাট্টা এড়িয়ে দক্ষিণের জেলাগুলোতে তো বটেই, মিজোরাম, মনিপুরে যাওয়া যাবে আগরতলা থেকে।
যদিও এর বিশাল নির্মাণযজ্ঞের জন্য আপাতত যানজটের হ্যাপা সামলাতে হচ্ছে আগরতলাবাসীকে।
ঢাকা থেকে সাকুল্যে ১৩০ কিলোমিটার দূরত্ব এই আগরতলার। সকাল সাড়ে আটটায় এয়ারপোর্ট স্টেশন ছাড়া মহানগর প্রভাতী আখাউড়া জংশনে পৌছে বেলা পৌনে ১১টায়। সেখান থেকে ১শ’ টাকায় রিজার্ভ করা অটোরিকশা মিনিট পনোরেতেই পৌছে দেয় আখাউড়া স্থল বন্দরে।
সেখানে বাংলাদেশের আমদানি পণ্য বোঝাই ট্রাকের সারি। আতরতলায় ঢোকার অপেক্ষায়। প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি টাকার পণ্য এখানে ঢোকে বাংলাদেশ থেকে।
বাংলাদেশ অংশে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের কাজ এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চললেও ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়া হয়েছে আগরতলায়। স্ক্যানিং মেশিন আর ছবি তোলার ক্যামেরাও বসেছে সম্প্রতি। তবে বাংলাদেশ বা ভারত কোনো অংশেই বাড়তি কোনো হ্যাপা হয়নি। উভয় অংশের কর্মকর্তারাই আচরণে ছিলেন আন্তরিক। ভারতীয় অংশের কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে আগরতলার খোলা হাওয়ায় বেরুতেই ফুলের শুভেচ্ছায় চমকে দিয়েছেন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র সিনিয়র প্রেজেন্টার সিদ্ধার্থ হালদার ও সহিত্য পত্রিকা আরশি কথা’র সম্পাদক শান্তনু শর্মা।
যদিও শর্মা নয়, ভট্টাচার্য তার উপাধি। ১৯৪৪ সালে ছাপিয়া প্রেস থেকে ‘নবজাগরণ‘ নামে যে ঐতিহাসিক পত্রিকাটির প্রকাশ ঘটে, সেটার সম্পাদক ছিলেন তার দাদা, গঙ্গাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য তাকে শর্মা উপাধি দেন ত্রিপুরার রাজা। সাত দশকেরও বেশি সময় পর তার নাতি শান্তনু শর্মার সম্পাদনায় এখন প্রকাশ হচ্ছে ‘আরশি কথা’। বাংলানিউজ যার মিডিয়া পার্টনার।
ঢাকা ছাড়ার পর মাত্র ঘণ্টাচারেকের মধ্যে আগরতলায় আবাস হলো জয়নগরের আবাসিক হোটেল লগনে। দুপুরে খাবারের মেনুতে যে মাছ দেওয়া হলো সেটাও যে বাংলাদেশ থেকে আসা তা গর্বভরেই জানালো হোটেল কর্তৃপক্ষ।
মহানগর প্রভাতীর এসি কেবিনে সিট প্রতি ভাড়া সাড়ে চারশ’ টাকা। তবে চট্টলা এক্সপ্রেসে এলে মাত্র দু’শ’ টাকা ভাড়া গুণতে হবে আখাউড়া পর্যন্ত। সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেকের মতো। আখাউড়া জংশন থেকে ল্যান্ড পোর্ট পর্যন্ত মাথাপিছু ২০ থেকে ৩০ টাকা নেবে অটো ভাড়া। সীমান্ত পেরুলে আরো ২০ থেকে ৩০ টিকা রিকশা ভাড়ায় ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা শহর।
এই ত্রিপুরার আয়তন ১০ হাজার ৪৯২ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনে এটি ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে মৈত্রী সেটা এই ত্রিপুরাতে একটু বেশিই। এর উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ঘিরে আছে বাংলাদেশ। চলবে
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৬
জেডএম/