আগরতলা (ত্রিপুরা) ঘুরে: কষ্টিপাথরের স্তম্ভ দু’টিতে চোখ না আটকে পারেই না। বহুভূজী নিরেট শরীরে দেব-দেবীদের মূর্তি উৎকীর্ণ।
১৯০১ সালে মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য এর উদ্যোগে নির্মিত এই প্রাসাদ এখন উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাদুঘর। তবে ভারতীয়দের জন্য এখানে প্রবেশ মূল্য মাত্র ১৫ রূপী রাখা হলেও বিদেশিদের জন্য দেড়শ’ রুপী করে। রূপীকে বাংলাদেশের মতো টাকাই বলে এখানে।
বিশাল প্রাসাদের পশ্চিম অংশের নিচ ও ওপরতলা মিলিয়ে গড়া জাদুঘরটি পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। প্রদর্শিত প্রত্নবস্তুর পাশে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি ত্রিপুরা জাতির নিজস্ব ভাষা ককবরক এ বিবরণ লেখা কোনো কোনোটিতে।
এই ককবরক ভাষা স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিল ৫৮৫ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ত্রিপুরা রাজ্য ভারতে অঙ্গীভূত হলে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা হারায় ককবরক। তবে এই ভাষাকে ১৯৭৯ সালে ফের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয় ভারত সরকার।
এ ভাষার লেখ্যরূপ দেওয়া হয় দেবনাগরী লিপিতে। তবে ইউরোপীয় মিশনারী প্রভাবিত কোনো কোনো গোষ্ঠী রোমান লিপিও ব্যবহার করেন। আদতে এই ককবরক অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত, গোত্রভুক্ত এশিয়ান বিভাগের টিবেতো বার্মিজ এর। বাংলাদেশ ও ভারতের লাখ বিশেক মানুষ এখনো এ ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা ও সিলেটের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ককবরকের চল আছে।
জাদুঘরের গ্যালারিগুলো প্রত্নতত্ত্ব, উপজাতীয় সংস্কৃতি, পেইন্টিং, বিভিন্ন যুগের ভারতীয় সংস্কৃতির নির্দশন হিসেবে ভাগ করা। কেবল ত্রিপুরা নয়, গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল তো বটেই, তাবৎ ভারতসহ বিভিন্ন সভ্যতার নির্দশন আছে এখানে। এমনকি দেখা গেলো মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার কিছু প্রস্তর মুদ্রাও।
পশ্চিম ত্রিপুরার বক্সনগর, দক্ষিণ ত্রিপুরার পিলাক, গোমতীর অমরপুর ও ছবিমুড়া, উত্তরের উনকোটি ইত্যাদি স্থানে পাওয়া অনেক প্রস্তর মূর্তিও এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে। আছে গাছের জীবাশ্ম, প্রেট্রোলিয়াম আর প্রাকৃতিক গ্যাসের মানচিত্র। আছে বিভিন্ন যুগের চারু ও কারু শিল্পের অনেক নিদর্শন। বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া সোনা, রূপা আর তামার মুদ্রাও আছে। মৃৎশিল্পের পাশাপাশি পোড়ামাটি ও ব্রোঞ্জ নির্মিত মূর্তি ছাড়াও আদিম যুগের বেশ কিছু শিলালিপি দেখা গেলো গ্যালারিতে। আনিন্দসুন্দর তৈল চিত্র এবং বস্ত্র আর অলঙ্কারে জ্বলজ্বল করছে কোনো কোনো গ্যালারি।
বাংলাকাহিনী আর সংস্কৃত মহাকাব্যের সংগ্রহও আছে বেশ। আছে দীর্ঘ সময় ত্রিপুরা শাসন করা মাণিক্য রাজবংশের রাজাদের চিত্র ও ইতিহাস।
১৯৪৭ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ত্রিপুরা শাসন করতো মাণিক্য রাজবংশ। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এই রাজবংশের ১৮৬ জন রাজা ত্রিপুরা শাসন করেন বলে কথিত আছে।
প্রাচীন উপকথা অনুসারে, ত্রিপুরার সীমানা বিস্তৃত ছিল গারো পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।
আর বাংলাপিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ১২৬৮ থেকে ১২৮১ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসক ছিলেন তুগরল খান। তিনিই সর্বপ্রথম ত্রিপুরার একটি অংশ জয় করে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করেন। সুলতান হুসেন শাহ ১৫১৩ সালে ত্রিপুরার সমভূমি অঞ্চলের বৃহত্তর অংশ অধিকার করেন। বাংলার মুঘল সুবাদার ইব্রাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৮) ত্রিপুরাকে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
মুর্শিদ কুলি খানের শাসনকালে ত্রিপুরার সমভূমি অঞ্চলের নতুন নামকরণ হয় রওশনাবাদ পরগনা। ত্রিপুরারাজকে সে অঞ্চলের জমিদার ঘোষণা করা হয়। সে সময় ত্রিপুরার মাণিক্য রাজারা পাহাড়ি ত্রিপুরার অধীনস্থ রাজা হিসেবে পরিচিতি পেতেন।
বর্তমান বাংলাদেশের হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনী জেলা সমন্বয়ে গঠিত হয় এই রওশনাবাদ পরগনা। কুমিল্লা ছিল রাজার জমিদারির সদর দপ্তর। ১৭৯০ সালে গঠিত নতুন ত্রিপুরা জেলার মূল অংশ ছিল ত্রিপুরা রাজার জমিদারি এলাকা।
ব্রিটিশ-ভারতে ত্রিপুরা হয় স্বাধীন করদ রাজ্য। তৎকালীন দক্ষিণ ত্রিপুরায় উদয়পুর ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক ত্রিপুরার রাজধানী। আঠারো শতকে মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্য পুরাতন আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় অধুনা আগরতলায়। ১৮৩৮ সালে আগরতলার পত্তন হয় মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্যের হাতে। সূচনা হয় ত্রিপুরার আধুনিক যুগের। পরে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অনুকরণে ত্রিপুরার প্রশাসন পুনর্গঠন করেন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর দেববর্মা।
১৯৪৭ সালে ভারত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয় ত্রিপুরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বাঙালি শরণার্থীরা। ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা রূপ নেয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। ১৯৭২ এর ২১ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের স্বীকৃতি পায় ত্রিপুরা। চলবে
**মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা
**আড়াইশ’ টাকায় আগরতলা, ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা
বাংলাদেশ সময়: ১০১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৬
জেডএম/