এ সড়কে যে একবার আসবে তার আর ফিরে যেতে মন চাইবে না। এক দিকে মেঘের লুকোচুরি।
পর্যটক হিসেবে কেউ যদি এ জেলায় আসেন, আর এই অনুপম স্বর্গ-সরণি না দেখে ফিরে যান তাহলে তার ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। এখানে এসে এ সড়কটি একবার অবলোকন না করলে ভ্রমণটাই মাটি হয়ে হয়ে যাবে।
চোখে মায়ার অঞ্জন-বোলানো এই সড়ক আপনাকে নিমেষে টেনে নেবে এক গভীর ভাবের রাজ্যে। কানে বেজে উঠবে কবিগুরুর সেই গানের পঙ্ক্তি:
“গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভোলায় রে। ”.............
আঁকাবাকা এই সড়কটিতে কি নেই! ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি জুড়ে কতো দৃশ্য, কতো নয়নমনোহর ছবির আলেখ্য যে ছড়ানো। এসব বর্ণনা করবার নয়, বরং চোখ মেলে, প্রাণ ভরে দেখার। বনভান্তের স্মৃতিমন্দির
বৌদ্ধ ধর্মগুরু শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের জন্মস্থানকে সংরক্ষণে রাখতে জেলা সদরের বড়াদাম এলাকার মোরঘোনায় কাপ্তাই হ্রদে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া তার প্রতি সম্মান রেখে মূল সড়কের উপরে বনভান্ত স্মৃতিমন্দির তৈরি করা হয়েছে। এ মন্দির এখন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এ মন্দিরে হাজার ভক্তের ভিড় লেগে থাকে। তাই আশাপাশজুড়ে টি-স্টল ও ছোট্ট হাটবাজার বসে প্রতিনিয়ত। পাহাড়ি নারীরা তাদের বিভিন্ন পাহাড়ি তরিতরকারী নিয়ে হাজির হয় এসব হাটবাজারে। হ্রদে দেখতে পারেন পাহাড়ি ললনাদের মাছ শিকার। এ এলাকা এতই মনোমুগ্ধকর যে, নিমেষে আপনার দেহমনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। অবসাদ দূর করতে একটু দাঁড়িয়ে চা খেয়ে নিতে পারেন আর অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন।
বড়াদাম থেকে রাঙামাটি শহর দেখা
এ সড়কের বড়াদাম এলাকায় দাঁড়িয়ে আপনি গোটা রাঙামাটি শহরকে এক নিমিষে দেখতে পাবেন। এ সড়কে দাঁড়িয়ে রাঙামাটি শহরকে দেখলে মনে হবে অথৈ সাগরে যেনবা একটি দ্বীপ।
বড় গাঙ রেস্টুরেন্ট:
সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে ভুরিভোজ করে নিতে পারেন বড়াদম এলাকায় পাহাড়ি বৈচিত্র্যের ঢঙে গড়ে ওঠা ‘বড় গাঙ’ রেস্টুরেন্টে। এক অপরূপ সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন এ হোটেলকে। পাহাড়ি খাবার থেকে শুরু করে দেশীয় খাবার—সবই পাওয়া যাচ্ছে অল্প দামে। খাবার শেষে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চুটিয়ে আড্ডাও দিতে পারেন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বসার সুব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এখানে।
বেড়ান্নে রেস্টুরেন্ট:
‘বড় গাঙ’ রেস্টুরেন্ট থেকে ৩০০ গজ দূরেই কিছু তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন ‘বেড়ান্নে’ (বেড়ানো) রেস্টুরেন্ট। এখানে এসে খাবার না খেলে বোঝাই যাবে না কাকে বলে ‘রসনাবিলাস’। এখানে এসে হোটেলের কেবিনে খেতে না চাইলে আছে টঙ ঘর। সেই টঙ ঘরে বসে দুপুরের ভুরিভোজ সারতে পারেন। কফি হাতে আড্ডা জমানোর জন্য রয়েছে হ্রদের পাড়ে সুব্যবস্থা। এ হোটেলের পাশের হ্রদটি দেখে মনে হবে, যেন থাইল্যান্ডের কোনো এক জায়গায় বসে আছেন। এছাড়া সাহসীদের হ্রদভ্রমণের জন্য এ হোটেলের রয়েছে কয়েকটি প্যাডেল বোট। এ প্যাডেল বোট দিয়ে কাপ্তাই হ্রদে আয়েশ করে ভেসে বেড়াতে পারেন দিব্যি।
হোটেল মালিকদের অনুভূতি:
‘বেড়ান্নে’ রেস্টুরেন্টের স্বত্তাধিকারী হিল্লোল চাকমা। তিনি বললেন, আমাদের নিজস্ব জায়গার উপর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি কয়েকজন বন্ধু মিলে ঝুঁকি নিয়ে এ ব্যবসায় নেমে পড়ি। আমি বিশ্বাস করি, এ সড়কে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা যায়, বিদ্যুৎসমস্যা দূর করা যায় তাহলে দিনের পাশাপশি রাতেও আমাদের ব্যবসা চাঙ্গা থাকবে।
‘বড় গাঙ’ রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী প্রিয়দর্শী চাকমা। তার ভাষ্য, অত্যন্ত পরিছন্ন পরিবেশে আমরা পর্যটকদের জন্য খাবার তৈরি করি। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও এখানে যে কেউ পাবেন সুস্বাদু খাবারে রসনাতৃপ্তির সুযোগ। এখানে পাহাড়ি এবং দেশীয় সব খাবারই পাওয়া যায়। যে যেটা খেতে পছন্দ করে সেটা খেতে পারবে। আমরা হোটেলের পুরো কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি। পুরো কাজ শেষ হলে আমাদের হোটেলে খাবারের মেন্যুর বহরও বাড়ানো হবে।
বড়াদম হাটবাজার:
জেলা সদরের সবচেয়ে পুরনো হাট বা বাজার বড়াদম। এ বাজার কখন গড়ে উঠেছে কেউ ঠিক করে বলতে না পারলেও স্থানীয় কয়েকজন পাহাড়ি প্রৌঢ় বলছেন, ১৯৮৫ সালের দিকে এ হাট বা বাজারটি গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এখানে হাট বসে। ফলমূল, শাকসবজি সবই পাওয়া যায়। আর ভ্রমণ শেষে বাড়ির জন্য তাজা শাকসবজি কিনে নিতে পারেন এ হাট থেকে।
রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ ব্রিজ:
কাপ্তাই উপজেলায় যেতে হলে এ ব্রিজ মাড়িয়েই যেতে হবে। আর এ ব্রিজ মাড়িয়ে যাবেন আর এর সৌন্দর্য অবলোকন করবেন না, তা কি হয়! অনেক পর্যটক তাই একটু প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে কিংবা সেলফিপাগল মানুষেরা নেমে পড়েন সেলফি তুলতে। এছাড়া স্থানীয়রা অবসর সময়ে এ ব্রিজের উপর মেতে ওঠেন আড্ডায়।
আর্জেন্টিনা ব্রিজ:
রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ সড়কের ডানপাশে শহরের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে এ ব্রিজ। কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত ব্রাহ্মণটিলা-আসামবস্তি সংযোগ ব্রিজটি আর্জেন্টিনা পতাকার রঙে রাঙিয়ে তোলার কারণে স্থানীয়রা এ ব্রিজের নাম দিয়েছেন ‘আর্জেন্টিনা ব্রিজ’। বিকেলে সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষের ঢল নামে এ ব্রিজে।
সূর্যাস্ত দেখা:
সূর্যাস্ত দেখতে পারেন এ সড়কে। আর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মন শুধু একটি কথা বলবে, ‘হে প্রকৃতি, আজকের মতো বিদায়, আবার দেখা হবে...’।
এ সড়কের নিরাপত্তা
রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ সড়কটিতে ভয়েরও কারণ রয়েছে। এ সড়কে সন্ধ্যার পর চলাচলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ সড়কের কাপ্তাই উপজেলার প্রবেশমুখে বন্য হাতির পাল নেমে আসে। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় অঘটন। এছাড়া এ সড়কে বিদ্যুৎ না থাকায় বড় দুর্ভোগ পোহাতে হয় স্থানীয় অধিবাসীসহ পর্যটকদের। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সন্ধ্যা নামার আগেই এ সড়কে অবস্থান না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পর্যটকদের অভিমত:
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা ৩৫তম বিএসএস পাশ করা পপি জানান, এ সড়কে না এলে আমি জানতামই না রাঙামাটি এ সুন্দর। এ সড়কে যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা যায় তাহলে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাবে।
পপির বান্ধবী এনজিওকর্মী ইসরাত জাহান বলেন, এ সড়কের প্রস্থ বাড়াতে হবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাতযাপনের উপযোগী কোনো কটেজ এখানে নেই। যদি কয়েকটি কটেজ গড়ে তোলা যায় তাহলে এ জায়গা হবে সম্ভাবনাময় ট্যুরিস্ট এলাকা।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোমান জানান, আঁকাবাকা রাস্তার সাথে কাপ্তাই হ্রদ মিলে মিশে একাকার। তিনি বলেন, আমি মালদ্বীপে গিয়েও এত সুন্দর জায়গা কম দেখেছি।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পারভেজ জানান, এ সড়কটির চারপাশটা এতো সুন্দর যে, দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এখানে হ্রদে যদি উন্নত মানের প্যাডেল বোট, সাম্পান নামানো যায় তাহলে পর্যটকরা হ্রদভ্রমণ করতে পারবেন। এছাড়া এ সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং রাত্রিযাপনের জন্য যদি কটেজ তৈরি করা যায়, তাহলে এ এলাকায় পর্যটনশহর গড়ে উঠবে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভ রক্ষিত জানান, এ সড়কে আরো কয়েকটি পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ সড়টিতে নিরাপত্তা জোরদার করে যদি কয়েকটি ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলা যায়, তাহলে এ জেলায় আরেকটি অদ্বিতীয় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে।
তবে তারও আগে এ সড়কের দুই ধারে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, পর্যটকদের থাকার জন্য কটেজ তৈরি করতে হবে। তাহলে পর্যটকদের সমাগম আরো বাড়বে।
বেড়াতে আসবেন যেভাবে:
ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বাইরে থেকে বাসযোগে এসে রাঙামাটি শহরে নামবেন। তারপর শহর এলাকা থেকে অটোরিক্সা কিংবা মাইক্রো ভাড়া করে চলে আসতে পারেন শহরের আসামবস্তি সড়ক পাড়ি দিয়ে রাঙামাটি-কাপ্তাই অভিমুখী বিকল্প পথে। যারা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসবেন তাদের তো কথাই নেই, সোজা চলে যেতে পারেন।
এ বিষয়ে ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও রাঙামাটি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা জানান, এ এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের মন্দির রয়েছে। আর এ মন্দিরে হাজার ভক্তদের সমাগম ঘটে। যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটনশিল্পের বিকাশের কথা মাথায় রেখে সরকার এ এলাকার উন্নয়ন ঘটায় তাহলে বড় কাজ হবে। একদিকে যেমন শহরের ভিতর আরেকটি পর্যটনশহর গড়ে উঠবে, তেমনি ধর্মীয় স্থানটিরও সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। পর্যটনশিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের ভাগ্যর চাকা ঘুরে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৭
এমইউ/জেএম