মন খারাপ করা বিষণ্ন বিলম্বিত শীত যেন পৃথিবীর মায়া ছাড়তেই চায় না। তারপরও এক দু’দিন একটু উষ্ণ রোদ্দুর, কুয়াশার আচল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা নীল আকাশ, আর পথে-ঘাটে ফুটে থাকা ফুল মনে করিয়ে দেয় বসন্ত এসে গেছে।
বিলেতে বসন্তের ফুল বলতে প্রথমেই আসে যার কথা তার নাম ড্যাফোডিল। ওয়ার্ডওয়ার্থ যার কথা কবিতায় লিখে গেছেন। ড্যাফোডিল এখানে ঠিক বাগানের আদরে লালিত ফুল নয়, ও এমনিই পথের ধারে ফুটে থাকে। হলুদ পাপড়ির ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে ড্যাফোডিল পৃথিবীটাকে ভালো করে দেখে নেয়। কিছু ফুলের রং চাপা সাদাও হয়।
ড্যাফোডিলের অন্য নাম নারসিসাস। সেই যে সেই গ্রিক পুরানের এক তরুণ যে কিনা আর সব ভুলে শুধু নিজের প্রতিচ্ছবিকেই ভালোবাসতো। ড্যাফোডিল ফুলও নিজের রূপে মগ্ন হয়ে চারদিক আলো করে ফুটে থাকে।
লন্ডনে বিভিন্ন রাস্তার ধারে অথবা পার্কে সরকারি উদ্যোগে ড্যাফোডিল গাছ লাগানো হয়। গাছগুলো ছোট ছোট আর লম্বা পাতাযুক্ত। সবগুলো ফুল যখন একসঙ্গে ফোটে তখন দেখে মনে হয় যেন এক হলুদ সমুদ্র।
যেন একঝাঁক হলদে পরী বাতাসে দুলতে দুলতে খল খল করে হাসছে।
তারপর আসে যার কথা তার নাম ক্যামেলিয়া। রবীন্দ্রনাথ যে ফুলের কথা লিখেছেন কবিতায়। বাংলাদেশ বা ভারতে ক্যামেলিয়া ফুল আমার চোখে কখনও পড়েনি, লন্ডনে এসে দেখলাম সে ফুলের বাহার।
ক্যামেলিয়া চিরসবুজ একধরনের ছোট গাছ, অনেকটা আমাদের দেশের কামিনীফুল গাছের মতো হয়। পাতা যদিও কামিনী পাতার চেয়ে বড়। ফুল যেন গোলাপের অপর রূপ। লাল আর গোলাপি এ দুটো রঙের ফুলই বেশি দেখা যায়। সাদা আর হলুদও ফুল হয় তবে তা খুব কমই দেখা যায়।
বসন্ত আসতে না আসতেই ক্যামেলিয়া গাছের আপাদমস্তক ভরে যায় অপূর্ব ফুলে, সে দৃশ্য স্বর্গীয়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাঁওতাল মেয়ের কালো গাল আলো করা ক্যামেলিয়া বাগান আলো করে ফোটে।
আরেক ফুল হলো ম্যাগ্নোলিয়া। ম্যাগ্নোলিয়া বড় গাছ, বেশ ছড়ানো ডালপালা। ফুল ফোটে গাছ ভরে যখন কিনা গাছে একটি পাতাও থাকে না। দীর্ঘ শীতঘুমের পর গাছ আড়মোড়া ভাঙে ফুলের সাজ সেজে।
বিলেতের ম্যাগ্নোলিয়া আমাদের দেশের ম্যাগ্নোলিয়ার মত নয়, আমাদের দেশে গাঢ় সবুজ পাতার আড়ালে একটা দুটো সাদা ফুল দেখা যায়, এখানকার গাছের পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল ফুল আর ফুল, তাদের রং একদম দুধে আলতা। আমাদের দেশি ম্যাগ্নোলিয়া গাছ ও আছে কিছু।
টিউলিপ ফুলের সৌন্দর্য আমরা সবাই জানি। যারা সিলসিলা সিনেমার সেই বিখ্যাত গানটা দেখেছেন যেটা হল্যান্ডের টিউলিপ বাগানে ধারণ করা হয়েছিল, তারা তো জানেনই। লন্ডনে অতো বড় টিউলিপ বাগান নেই, লোকে শখ করে বাগানে একটা দুটো গাছ লাগায়। রঙের বাহারে টিউলিপ সেরা, কত যে তার রং আর বাহার তা বলে শেষ করা যাবে না।
বিলেতে বসন্তের ফুলের কথা শেষ করছি আমাদের পরিচিত একটি ফুল দিয়ে, যার নাম চেরি। মন ভালো করে দেওয়া সাদা, হালকা গোলাপি আর গাঢ় গোলাপি ফুল বসন্তের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফোটে। শীতের শুরুতে চেরি গাছের পাতা পড়তে শুরু করে, ন্যাড়া হয়ে যায় গাছ। কিন্তু বসন্তে তার শুকনো ডাল ভরে ওঠে অজস্র ফুলে। কোনো পাতা নয়, শুধু ফুল আর ফুল।
লম্বা ডালের গোঁড়া থেকে আগা পর্যন্ত শুধু ফুল আর ফুল। লম্বা বৃক্ষ তার ফুলে ভরা ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় বসন্তকে। আমার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বেশ কয়টি চেরি গাছ দেখা যায়। বসন্তে যখন তার সারা দেহ ভরে যায় অপূর্ব ফুলে, তখন মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সে গান, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় ফাগুন মাসে কি উৎসবে ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা। ’ শিরীষ ফুল এখন দেখা হয়নি, তবে চেরিও কিছু কম সুন্দর নয়। আর সারা বসন্ত জুড়ে তার ফুল ফোটানর খেলা ক্লান্তিবিহীনই বটে।
পৃথিবীর আনাচে কানাচে কতো যে সৌন্দর্য কতো যে প্রাণ তা বলে শেষ করা যাবে না। সে সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখারই নয়, মন দিয়ে উপলব্ধি করারও বইকি। ইউরোপের দীর্ঘ বিষণ্ন প্রাণহীন শীতের পর প্রকৃতি যখন একটু একটু করে তার প্রাণ ফিরে পায়, তখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথ মিথ্যে বলে যাননি- আমারে তুমি অশেষ করেছ/এমনি লীলা তব/ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ/জীবন নব নব।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৭
এএ