হ্যাঁ সত্যি বলছি। রক্তের টানে, দেশের টানে, ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির টানে তিন দিনের জন্য ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম আমরা তিন শতাধিক বাংলাদেশি।
টোকিও থেকে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে শিযুওকা কেন এর হামামাৎসু সিটির “শিযুওকা ফরেস্ট পার্ক মরিনো ই” হোটেল এন্ড রিসোর্টে পৌঁছায়। অবশ্য অনেক আগে থেকেই পুরো হোটেলটি বুকিং করে রাখা হয়েছিল। অসাধারণ সুন্দর হোটেল। তিন শতাধিক মানুষের এক বিশাল আয়োজন। অনেকদিন পর বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার আমেজ। গল্প-আড্ডা-ঘুরাঘুরি-খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সব আয়োজনই ছিলো। তিন দিন মনে হয়েছে এ যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ!
জাপানের গোল্ডেন উইক বা টানা এক সপ্তাহের ছুটিকে পরিবারসহ উপভোগ করতেই মূলত এ আয়োজন করেছে ইসলামিক মিশন জাপান। প্রতিবছর জাপানে অবস্থিত বাঙালিরা এরকম দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়ার আয়োজন করে। এবারের আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো বাহারি বাঙালি খাবার। যা সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
ছোট-বড় সবার জন্য খেলাধুলার আয়োজন ছিল দেখার মতো। অন্যদিকে গান-কৌতুক-অভিনয়সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সন্ধ্যা রাতকে করেছে উৎসবমুখর। শিশুদের জন্য পৃথকভাবে ছিলো বাংলাদেশি সাংস্কৃতি, ভাষা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অবহিতকরণ প্রশিক্ষণ ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। কারণ ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা এসব শিশুকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না দিলে দেশপ্রেম হয়ত ভুলে যাবে। তাই নিজ দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগটি নিয়েছিলেন আমাদের আতিকুর রহমান ভাই।
শিশুদের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি নিজেই অবাক হয়েছি। বাঙালি পরিবারের এসব সন্তানে বাংলা বলতে গিয়ে আটকে গেলেও জাপানিজ ভাষায় বুলেটের মতো কথা বলছে!
পুরো ভ্রমণটি হয়েছে পরিকল্পনা মাফিক। প্রথম ও দ্বিতীয় দিন আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি পাহাড় ভ্রমণ। হোটেল থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই প্রায় হাজার মিটার উচ্চতায় বিশাল ঝুলন্ত ব্রিজ। এতো উঁচু যে এ ব্রিজে উঠে নিচের দিকে তাকিয়ে হার্টফেল করার মতো অবস্থা হয়েছে অনেকের। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।
হোটেলের তিন পাশেই পাহাড়। একপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের অপরূপ দৃশ্য। সত্যি দেখার মতো। তৃতীয় দিনে পাহাড় ঘেরা সাগরের পাড়ে সুবিশাল লেক ভ্রমণ। নীল জলরাশির এ লেকটি সরাসরি সাগরের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সুন্দর এ লেকটি দর্শনের জন্য রয়েছে নানা ধরনের রাইড। এর পাশেই রয়েছে হামামাৎসুশি ফ্লাওয়ার পার্ক ও চিড়িয়াখানা। সারাদিন ঘুরে ওখানেই একসাথে সকলে মিলে দূপুরের খাবার খাওয়া যেন আমাদের দেশের বনভোজনকেই মনে করিয়ে দিয়েছে।
ভ্রমণ কী কেবলই ঘুরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, আর ঘুমানো? না, মোটেই তা নয়। যে জায়গাটিতে যাওয়া হয় সেই জায়গাটির মাটি ও মানুষের পাশাপাশি ওই জায়গার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে মেলানোর নামই সত্যিকারের ভ্রমণ। এ ভ্রমণটিও তেমনি একটি ভ্রমণ।
শিল্প আর প্রযুক্তির প্রকৃত মেলবন্ধনের দেশ। চারপাশে সুদৃশ্য ঘর-বাড়ি ও সাজানো নানা বাগান দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিস্তৃত ছিমছাম রাস্তা দেখে সত্যি মন ভরে যায়। পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত জাপান প্রায় তিন হাজারের বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। জাপানে রয়েছে ৪৭টি প্রশাসনিক প্রিফেকচার যা কিনা অনেকটা প্রদেশের মত। জাপানিদের উন্নত রুচিবোধ, সৌন্দর্যজ্ঞান, নীতিধর্ম, শ্রমলদ্ধ সাধনা, প্রকৃতিবন্দনা এবং শিল্পচর্চার প্রতি তাদের ভালবাসা আমাদের আকৃষ্ট করেছে। জাপানে মুগ্ধ হওয়ার মতো বিষয়টি হচ্ছে, তাদের সময়জ্ঞান। প্রযুক্তির তীর্থক্ষেত্র, জাপানের সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টা, কিন্তু সার্বিক ক্ষেত্রে ব্যাবধান মনে হয় কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থা জীবনমুখী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জগাখিচুড়ি।
যাই হোক, টানা তিন দিন ভ্রমণের শেষ বিকেলে ফেরার কথা অনুষ্ঠানটির সমন্বয়ক আলাউদ্দীন ভাই ও এ টি এম মিজবাহুল কবির ভাই মাইকে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই সবার মন খারাপ হয়ে গেল। এমন স্বপ্নের শহর ফেলে কি কেউ আসতে চায়! পেটের টানে আবারো সেই যান্ত্রিক জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ভালো থেকো শিযুওকা কেন। সময় সুযোগ পেলে আবার দেখা হবে পাহাড় ঘেরা সাগরের পাড়ে।
একনজরে শিযুওকা কেন
শিযুওকা কেন্ হল জাপানের মূল দ্বীপ হোনশুর চুউবু অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এর রাজধানী শিযুওকা সিটি, এবং সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ নগর হচ্ছে হামামাৎসু। শিযুওকা কেনের মোট আয়তন ৭৭৭৯.৬৩ কিমি বা ৩০০৩.৭৩ বর্গমাইল। জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।
এর পশ্চিমে ও উত্তরে রয়েছে যথাক্রমে আইচি এবং নাগানো, য়ামানাশি ও কানাগাওয়া প্রশাসনিক অঞ্চল এবং পূর্বে ও দক্ষিণে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলভাগ। পশ্চিম সীমায় জাপানি আল্পস পর্বতমালা বিদ্যমান, এবং পূর্বের অধিকাংশ জুড়ে আছে একাধিক মনোরম পর্যটনকেন্দ্র সমৃদ্ধ ইযু উপদ্বীপ।
শিযুওকা প্রশাসনিক অঞ্চলের ১১ শতাংশ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর মধ্যে আছে ফুজি-হাকোনে-ইযু এবং মিনামি আল্পস জাতীয় উদ্যান; তেন্রিউ-ওকুমিকাওয়া উপ-জাতীয় উদ্যান এবং চারটি প্রশাসনিক আঞ্চলিক উদ্যান। শিযুওকা প্রশাসনিক অঞ্চলে চা, স্ট্রবেরি, কমলালেবু, পীচ ও গোলাপ ফুলের চাষ সবচেয়ে বেশি। এছাড়া উন্নত জিন প্রযুক্তিতে বীজবিহীন কমলালেবু অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিযুওকা কেনের সবকিছু পরিকল্পিত আর সাজানো-গোছানো। মনে হয়, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য থরে থরে সাজানো হয়েছে শহরের বাড়িগুলো। স্থায়িত্বের জন্য সব দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা ও গবেষণার ভিত্তিতে গড়ে তোলা। জাপানের প্রযুক্তি যতই দেখি, অবাক হই।
মাহবুব মাসুম: প্রবাসী সাংবাদিক, masum86cu@yahoo.com.
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৭
জেডএম/