মারকুইস স্ট্রিট (কলকাতা) থেকে: আক্ষরিক অর্থেই শুক্রবার (৩০ জুন) ছুটির নিমন্ত্রণে চলে এলাম কলকাতায়। ইউ-এস বাংলার বিএস২০১ ফ্লাইটটি ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কোনো বিলম্ব ছাড়াই পূর্বনির্ধারিত ১১টা ২০ মিনিটে উড়াল দিয়ে চোখের পলকে ১১টা ৫০ মিনিটে কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালো।
বোয়িং ৭৩৭ সুপরিসর আকাশযানের পুরোটাই যাত্রীতে ঠাঁসা। ঈদের ছুটিকে নানা প্রয়োজনে ভালো করেই কাজে লাগাচ্ছেন লোকজন।
‘আমরা ভ্রমণ আর চিকিৎসার কাজে যাচ্ছি’- জানালেন সহযাত্রী অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন। প্রায় সকল যাত্রীর চোখে-মুখে রিলাক্সড মুড। আয়েশ করে ঘুরে বেড়ানো আর প্রয়োজনীয় কাজের প্ল্যান নিয়ে সবাই যেন ছুটি কাটাতেই চলেছেন।
‘শুনলাম হোটেল পেতে খানিক কষ্ট হবে। সেন্ট্রাল কলকাতার নিউ মার্কেটের আশেপাশের হোটেলগুলো বাংলাদেশের পর্যটকে ভরপুর। অনেক কষ্ট করে হোটেলে রুম বুকিং করতে পেরেছি’- বললেন দোলন ভৌমিক।
আমি নিজেও ঈদের আগে-পরে কলকাতাগামী মানুষের ভিড় দেখেছি। দেশের অভ্যন্তরীণ বাস-ট্রেন রুটের মতো ঢাকা-কলকাতা রুটের বিমান টিকেটের চাপ টের পেয়েছিলাম আগেই। ঈদের পরদিন কলকাতা রওনা দেওয়ার চেষ্টা করে টিকেট পাইনি। শেষ পর্যন্ত বেশ চড়া দামে সেটি পাওয়া গেল ৩০ জুন তারিখের।
‘রাঙামাটিতে পাহাড় ধস আর যোগাযোগের সমস্যায় দেশের জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্রগুলোর বদলে কলকাতাকে মানুষ বেছে নিচ্ছেন ভিসার সুবিধা, মার্কেটিং, চিকিৎসাসহ বহুবিধ কারণে’- বললেন ফেরদৌসি আক্তার। ছেলেসহ চট্টগ্রামের এই গৃহিণী চলেছেন কলকাতা হয়ে মাদ্রাজ যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে।
‘ছেলের অনার্স শেষ। ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। সুযোগ পেলে হেল্থ চেক-আপটাও করাবো। ছেলের বাবা ছুটি ম্যানেজ করে দু’দিন পর আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন’।
ফেরদৌসির কথা শেষ হতে না হতেই দেখি, পুরো পরিবার, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-ছেলে, মা-মেয়ে- এমনতর নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে মহানগর কলকাতার নানা দিকে ছড়িয়ে গেলেন।
উড়োজাহাজ থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই কলকাতার আবহাওয়া জানিয়ে দিল, এখন পূর্ণ বর্ষাকাল। বিমানবন্দরের খোলা প্রান্তর থেকে আশেপাশে রঙের মেলা দেখা যাচ্ছে গাছে গাছে। ঢাকায় ফেলে আসা ভেজা বাতাসের তুলনায় গরমের টান এখানে খানিকটা বেশি। বাংলার পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তে এসে পেলাম উজ্জ্বল-উচ্ছল-উষ্ণ দিনের ঝলমলে আকাশ। ভাসমান মেঘের ভেলায় আলো-হাওয়ায় মিশে আছে সম্ভাষণের আর্দ্রতা।
রৌদ্রকরোজ্জ্বল জুনের শেষ দিনে কলকাতায় পৌঁছেই মনে পড়ল জোব চার্বনের কথা। বৃহৎ বঙ্গের অখ্যাত স্থানে এই নতুন শহরটি তৈরির পরিকল্পনা আরম্ভ করেন তিনি তৎকালীন সমৃদ্ধ ও প্রাচীন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মুর্শিদাবাদকে বাদ দিয়ে। তার ইচ্ছা ছিল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আলাদা জায়গা বানানো। চার্নকের স্বপ্ন সফল হয়েছিল। উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া স্বার্থের প্রধান ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল কলকাতা।
১৯১২ পর্যন্ত কলকাতা ছিল সমগ্র ব্রিটিশ-ভারতের ও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার রাজধানী। এখন কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী, দিল্লি ও মুম্বাইয়ের পর ভারতের তৃতীয় প্রধান মহানগর।
জব চার্নকের আগমনের সাড়ে তিনশ’ (১৬৬০-২০১৭) বছর পর সেই কলোনিয়েল কলকাতা আর নেই। কলকাতা এখন এশিয়ার তৃতীয় প্রধান নগরীও বটে।
আসার আগে চট্টগ্রামের ‘বাতিঘর’ বইয়ের দোকান থেকে ‘অ্যা সিটি ইন দ্য মেকিং: অ্যাসপেক্টস্ অব ক্যালকাটাজ আর্লি গ্রোথ’ বইটি নিয়ে কিছুটা পড়েছিলাম। নিতান্ত জলা-জঙ্গলে ভরা গ্রাম কিভাবে হয়ে উঠল আস্ত-মস্ত শহর, তারই রূপরেখা প্রচুর আর্কাইভাল রেকর্ডসের সাহায্যে বর্ণনা করেছেন রণবীর রায় চৌধুরী তার বইটিতে।
ঔপনিবেশিক বণিকের হাতে গোড়াপত্তনের ঠিক ৩২৭ বছর পর আমি এসে পৌঁছেছি কলকাতায়। সাধারণভাবে কলকাতাকে ‘সিটি অব জয়’ কিংবা ‘ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলা হলেও শহরটি আমাদের কাছে স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার ভূগোল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সময় বাংলাও ভাগ হয়। কলকাতা অন্তর্ভূক্ত হয় পশ্চিমাংশে। ভাগাভাগির ৭০ বছর পর আমাকে কলকাতায় আসতে হয়েছে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে।
রাজনৈতিক ইতিহাসের খেলায় বিংশ শতাব্দীতে একই বঙ্গভূমির পরিচয় তিন-তিনবার বদল হয়েছে। ১১২ বছর আগে যেবার বাংলা ভাগ হয়েছিল ১৯০৫ সালে, তখন তা ছিল একটি দেশেরই দু’টি প্রদেশ। প্রথমবারের মতো বঙ্গদেশ অস্থায়ী সীমারেখা দিয়ে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ নামে পরিচিত হয় ওই বছর। কয়েক বছরের মধ্যেই সেই বিভক্ত বঙ্গদেশ জোড়া লাগলেও বিভাজনের দাগ পুরোপুরি মুছে যায়নি। বরং ১৯৪৭ সালে সে দাগটিই অঙ্কিত হয় স্থায়ীভাবে।
সে পরিবর্তন কেবল মানচিত্রের পরিবর্তন ছিল না, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল সংস্কৃতি ও সমাজের ক্ষেত্রে।
কলকাতার নিকটবর্তী উত্তর চব্বিশ পরগনার দমদমে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নামকরণ করা হয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর স্মৃতিতে। ঢাকার ভেতরে যেমন নারায়ণগঞ্জ ঢুকে আছে, কলকাতার পূর্ব সীমানায় গা ঘেঁষে রয়েছে চব্বিশ পরগণা জেলা। একসময়কার একটি জেলা এখন উত্তর-দক্ষিণে দু’টি ভাগ হয়েছে। আমাদের সাতক্ষীরা-সুন্দরবন মিশেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সঙ্গে। যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গার পাশে উত্তর চব্বিশ পরগণা। উত্তরের দিকে ক্রমে ক্রমে নদীয়া, মুশির্দাবাদ, মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা বাংলাদেশের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে।
সড়কপথে যারা বেনাপোল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসেন, তারা চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ, রানাঘাট, বারাসাত, বশিরহাট ইত্যাদি এলাকা পার হয়ে কলকাতায় পৌঁছান। শুনলাম, বশিরহাটকে নতুন জেলায় উন্নীত করার কথা চলছে।
কলকাতার পূর্ব দিকে চব্বিশ পরগণা, পশ্চিম দিকের পুরোটাই নদী। নদীর ওপারে হাওড়া। কলকাতা আর হাওড়াকে বলা হয় ‘টুইন সিটি’। যাতায়াতের জন্য মধ্য কলকাতার পুরাতন হাওড়া ব্রিজের পাশাপাশি আরও সেতু নির্মিত হয়েছে। ব্রিজ এবং অনেকগুলা ফেরি সার্ভিস কলকাতা-হাওড়া সংযোগ বজায় রাখছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই।
দমদম ছাড়াও রাজ্যের উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির নিকটবর্তী বাগডোগরায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর রয়েছে, যেটি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত হয়েছে। আরও উত্তরের জনপদ কোচবিহারে নতুন বিমানবন্দর স্থাপিত হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের পূর্বাংশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা বিমানবন্দরটিকেও আন্তর্জাতিক মানের করার পরিকল্পনা আছে বলে জানা গেল। এতে শুধু নিজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলই নয়, বাংলাদেশকেও নিবিড় যোগাযোগ বন্ধনে আবদ্ধ করবে ভারত। ফলে চিকিৎসা, ভ্রমণ, কেনা-কাটা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ থেকে যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক পায় ভারত, সে সংখ্যা আরো বাড়াবে।
‘কলকাতা’ নামটির উৎস নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। মনে করা হয়, ‘কলিকাতা’ নামটি এসেছে ‘কালীক্ষেত্র’ নাম থেকে। অন্য মতে, বাংলা শব্দ ‘কিলকিলা’ ( ‘চ্যাপ্টা ভূখণ্ড’) কথাটি থেকে ‘কলিকাতা’ নামের উৎপত্তি। ‘কলিকাতা’ নামটি ‘খাল’ ও ‘কাটা’ (‘খনন করা’) শব্দ দু’টি থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে। অন্য একটি মতে, এ অঞ্চলে কলিচুন ও কাতা ( ‘নারকেল ছোবড়ার আঁশ’) প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো- তা থেকেই এ অঞ্চলের নাম হয় ‘কলিকাতা’। আগে ইংরেজিতে কলকাতার নাম ছিল ‘ক্যালকাটা’। ২০০১ সালে বাংলা উচ্চারণ অনুসারে ইংরেজিতেও রাখা হয় ‘কলকাতা’।
কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হলেও নগরীর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। ১৮৮৫ সালে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজের আদি ঘাঁটি, দূর্গ আর পরবর্তীতে রাজধানী হওয়ায় ভারতে ইংরেজদের হাতে অনেক কিছুই প্রথম স্থাপিত বা প্রচলিত হয়েছে এখানে।
বাংলার নবজাগরণ ও ব্রাহ্ম সমাজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদের উদ্ভব ও বিকাশও এই নগরে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সূত্রপাত কলকাতার অদূরে ব্যারাকপুরে হয়েছিল। ব্যারাকপুরে তখন ছিল ছোট্ট সেনা ছাউনি। এখন বিরাট ক্যান্টনমেন্ট। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড বা সংক্ষেপে বিটি রোড শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে সোজা চলে গেছে উত্তরের ব্যারাকপুরে। উত্তরের লোকজন এ পথ দিয়েই কলকাতায় প্রবেশ করেন। মধ্য কলকাতা হয়ে কালীঘাট পার হয়ে চলে যান টালিগঞ্জ, বেহালা, যাদবপুর কিংবা আরো দক্ষিণে গড়িয়া হাটে।
নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এলে সেন্ট্রাল কলকাতায় থাকা ভালো। এখান থেকে উত্তর, দক্ষিণ কিংবা অন্য প্রদেশে যাতায়াতের সুযোগগুলো হাতের নাগালের মধ্যেই পাওয়া যাবে। নিউ মার্কেটকে কেন্দ্র করেই থাকা, খাওয়া, যাতায়াতের সুবিধাগুলো ছড়িয়ে আছে।
দমদম থেকে সোজা ট্যাক্সিতে নিউ মার্কেটের পাশের মারকুইস স্ট্রিটে নেমে প্রথমেই হোটেল খুঁজে নেওয়ার কাজটি সেরে ফেলি। পুরো মারকুইস স্ট্রিট ও পার্ক স্ট্রিট জুড়ে অসংখ্য চলনসই হোটেল আছে। আশেপাশে মির্জা গালিব স্ট্রিট, জাকারিয়া স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট ইত্যাদি এলাকায়ও চমৎকার হোটেল দেখতে পেলাম। পেট্রাপোল বা বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে আসা বাসগুলোর কিছু নতুন শহর সল্টলেকে এবং অধিকাংশই এখানেই এসে যাত্রা সমাপ্তি করে। বাসগুলো যেখানে থামে, সেখানে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালেই অসংখ্য হোটেল চোখে পড়বে।
হোটেলে এসি, নন এসি, সব ধরনের রুমই আছে। সাধারণত ৫০০ থেকে ১০০০ রুপির ভেতরে ভাড়া। আরও বেশি ভাড়ার ভালো হোটেলও আছে। প্রথমদিনে পছন্দসই হোটেল খোঁজায় সময় নষ্ট না করে সবচেয়ে কাছের হোটেল সম্রাট বা হোটেল-২১ এ উঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন অভিজ্ঞজনেরা। তাদের মতে, পরদিন ধীরে-সুস্থে আমার সাধ ও সাধ্যের মধ্যে হোটেল খুঁজে নিতে পারবো।
পরামর্শানুসারে হোটেলগুলোতে গিয়ে সিট পেলাম না। অগত্যা অন্য আরেকটি হোটেল বেছে নিতে হলো। সেখানেও বাংলাদেশিদের সংখ্যাই বেশি।
থাকার ব্যবস্থা করে প্রথমেই মোবাইল ফোনের সিম কিনে নিলাম। ১৫০ রুপির মতো লাগলো। সঙ্গে দুই কপি ছবি ও পাসপোর্টের নির্দিষ্ট কিছু পাতার ফটোকপি। ব্যবসার কারণেই ওখানকার কর্পোরেট সার্ভিসগুলোতে বাংলাদেশিদের খুবই খাতির করা হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশিদের জন্যই এখানকার প্রায় সব সেলফোন অপারেটরেরই বাংলাদেশ প্যাকেজ আছে। এসব প্যাকেজের ফোন থেকে বাংলাদেশে যতো কম খরচে কথা বলা যায়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে তা যায় না।
থিতু হতে হতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পাশেই পার্ক স্ট্রিট এলাকায়। জায়গাটা একটু ঘিঞ্জি। তবে কেউ যদি কলকাতায় ট্যুরের জন্য এসে থাকেন বা চেন্নাই-ভেলোর-মাদ্রাজ-হায়দ্রাবাদ-বেঙ্গালুরু বা অন্যত্র যাওয়ার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চান কিংবা কলকাতায় যদি কারো পরিচিত কেউ না থাকে, তাহলে থাকার জন্য এ এলাকাই ভালো।
এখানে বাংলাদেশ বাংলাদেশ গন্ধ লেগে আছে। খেতে ঢুকলে বা রাস্তায় নোয়াখালী, চাটগাঁ, রংপুর, পুরান ঢাকা, সব ল্যাংগুয়েজই শুনতে পাবেন। মুসলিম প্রধান এলাকা হওয়ায় মুসলিম হোটেলও আছে একাধিক। কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন এখানেই। সোনালী ব্যাংকের শাখাও রয়েছে পার্ক স্ট্রিটের ওয়ান্ডারল্যান্ডের পাশে, পার্ক ম্যানসনে।
নিউ মার্কেট-পার্ক স্ট্রিট থেকে কলকাতার দর্শনীয় স্থানগুলোও নাগালের ভেতরে। ট্যাক্সি, বা রুট নম্বর জেনে ট্রাম ও পাবলিক বাস ব্যবহার করা যায় সহজেই। তবে যদি কেউ চিকিৎসার জন্য আসেন, সেক্ষেত্রে সেন্ট্রাল কলকাতায় না থেকে বাইপাস বা মুকুন্দপুর-সন্তোষপুরের আশেপাশে থাকাই ভালো। হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগ এ এলাকাতেই। আর থাকার খরচও মূল কলকাতার চেয়ে কম।
কড়া রোদ আর মেঘের লুকোচুরিতে উত্তপ্ত শেষ দুপুরটা খানিক বিশ্রামে পেরিয়ে গেল। ফোনে নানাজনের সঙ্গে কথাবার্তাও সেরে নিলাম। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা আমার কিছু পরিবারের সঙ্গে দেখা করবো। যারা ১৯৪৭ সালের ভাগাভাগিতে কলকাতায় এসেছেন এবং যাদের তৃতীয় প্রজন্ম চলছে এখন। এখানেই বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। সেইসব মানুষের সঙ্গে পারিবারিক স্মৃতি ও অতীতের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলাই আমার লক্ষ্য। তাদের বসতির খোঁজে আমি উত্তর কলকাতার বেলঘড়িয়া, মধ্যমগ্রাম ইত্যাদি এলাকায় যাবো। গড়িয়াহাটে অনেকগুলো ব্যবসা-দোকানের কর্ণধারদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। আলাপ করে সেভাবেই রুটিন গুছিয়ে নিলাম।
বিকেলে হোটেল থেকে বাইরে এলাম। ফুরফুরে বাতাসে বেশ একটা চনমনে ভাব। দূরে না গিয়ে মারকুইস স্ট্রিট থেকে কাছের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে হাঁটা পথের দূরত্বের নিউ মার্কেটে পৌঁছালাম অল্পক্ষণেই। ঢাকার গাউসিয়া, চাঁদনিচক, ধানমণ্ডি হকার্স, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, বাবুপুরা ও গাউসুল আজম মার্কেটের মিলিত আয়তনের সমান হবে নিউ মার্কেট। আশেপাশে নানা নামের ছোট-বড় ও পুরনো মার্কেট নিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার। চরিত্রে বারোয়ারি বাজারের আমেজও স্পষ্ট, আর আছে ভিড়।
এবার অন্যদিকে চৌরঙ্গি এসপ্ল্যানেডের দিকে হেঁটে ধর্মতলার দিকে এলাম। টিপু সুলতান মসজিদের সামনে পৌঁছাতেই মাগরিবের আজান হল। কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ও বিভিন্ন দিকে যাতায়াতের রাস্তাগুলো এখান থেকে ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন দিকে।
প্রাচীন ট্রাম যোগাযোগের দেখা পেলাম এখানে। ট্রাম ডিপোর কাছে দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার। মালদহ, শিলিগুড়ির বাসও আছে দেখলাম। ‘বাসে মানুষ বিপদে না পড়লে দূরের যাত্রা করেন না। ট্রেনে টিকিট না পেলেই বাস বেছে নেন’- আলাপ প্রসঙ্গে জানালেন কাউন্টারের ভদ্রলোক।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া নিয়ে লোকজনের ভিড় বাড়ল। উত্তর বা দক্ষিণের যাত্রীরা কাজের শেষে ঘরে ফিরে যাওয়ার তাড়া নিয়ে চলেছেন। এক সময় চৌরঙ্গি, এসপ্লানেডে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের প্রাধান্য থাকলেও সেদিন আর নেই। আশেপাশে হিন্দিভাষিদের প্রাধান্য স্পষ্ট।
ভিড় এড়িয়ে আমি কার্জন পার্কের দিকে চলে এলাম। পার্কটির নাম বদলে এখন রানী রাসমনির নামে রাখা হয়েছে। বহু আগে এখানে সাহিত্যিক বিমল মিত্রের সঙ্গে আড্ডায় বসতেন তরুণ সাহিত্য যশঃপ্রার্থী সুনীল, শীর্ষেন্দুরা। বহু মানুষের উত্থান আর পতনের স্বাক্ষী প্রাচীন মহানগরী কলকাতার মায়াময়তায় আচ্ছন্ন হতে হতে আমি শহীদ মিনার পেরিয়ে আকাশবানী ভবনের দিকে হাঁটছি। পেছনে বাণিজ্যিক নগরের কোলাহলের চেয়ে প্রাকৃতিক, খোলামেলা, বৃক্ষবহুল, গঙ্গাঘেঁষা অংশটিই আমাকে বেশি টানছে।
ইডেন মাঠের বাইরের দিকটা দেখলাম ডাল মিয়া ও অন্যান্য ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের ছবি ও অলঙ্করণ দিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। রাস্তার ওপাশে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠ। পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের প্যাভিলিয়ন। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের তিন ঐতিহ্যের জন্য খেলাধুলা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এখান থেকে চারপাশে তাকিয়ে দেখছি আর আদি কলকাতার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শুনছি। দেখা যাচ্ছে রাজভবন, সেক্রেটারিয়েট, ফোর্ট উইলিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়েলও আশেপাশেই। রাতের দিকে এসব স্থাপনার বাইরের দিকটি ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না। আমি বরং সামনের দিকে হাঁটতে থাকি রাজভবনের বিশাল প্রাচীর ঘেঁষা ফুটপাত ধরে।
পথ মনে হচ্ছে আমাকে গঙ্গার দিকে টানছে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রাচীন মহীরূহ ও উদ্যান থেকে নদীর জল মাখানো-বৃক্ষের পল্লব ছোঁয়া বাতাস ক্লান্তি শুষে নিচ্ছে। নগর ব্যবস্থাপনায় নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর আরাম ভালো লাগলো। হকার বা ভবঘুরের দঙ্গল নেই। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ও নীরবতা যথার্থই রক্ষা করা হয়েছে। চুরি-ছিনতাইয়ের ভয়ও খুব একটা নেই। শুধু মাঝে মাঝে পুলিশকে পরিচয় জানাতে হচ্ছে। পাসপোর্ট দেখতে চাইল একবার।
কখন চলতে চলতে গঙ্গার তীরের বিখ্যাত প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে চলে এলাম। পাশেই আউটরামের ঘাট ও বিখ্যাত চন্দ্রপাল বা চাঁদপালের ঘাট, যে ঘাটে এসে ভিড়ত ব্রিটিশ জাহাজের পণ্য এবং ভাগান্বেষী ইংরেজ তরুণ-তরুণী। রাতের অস্পষ্ট নদীর দিকে তাকিয়ে আমার চোখ পৌঁছে গেল ইতিহাসের গভীরতম পাতারও গভীরে।
বাইরে তখন আকাশ কালো করে মেঘেদের আনাগোনা। ‘এ বর্ষায় দিনগুলো গরম আর খটখটে, রাতগুলো বৃষ্টিমুখর। প্রতিরাতেই ভারি জল পড়ছে’- পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই পথচারীর কথা কানে আসায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মধ্যরাত তখন কড়া নাড়ছে কলকাতার দরোজায়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৭
ইএস/এএসআর