তিনি হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)। ইসলামের অন্যতম বীরযোদ্ধা।
শাওয়াল মাসে ৬টি নফল রোজা রাখার সহি হাদিসটি তার কাছ থেকেই পাওয়া। তিনি ১৫০টি হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন। মদিনার বনু নাজ্জার বংশোদ্ভূত আবু আইয়ুব আনসারির শেষ আশ্রয় হয়েছিল তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলে। তুরস্কে তিনি পরিচিত আয়ুপ সুলতান নামে।
দাফনের সাড়ে সাতশ বছর পর ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এই সড়কের ওপর দিয়েই অটোমেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমুতের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে ঢুকেছিল। পূরণ হয় আইয়ুব আনসারি (রা.) স্বপ্ন। পরে সুলতান মেহমুতের এক শিক্ষক আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) সমাধিটি আবিষ্কার করেন। ১৪৫৮ সালে সুলতানের উদ্যোগে একটি অলংকৃত সমাধি এবং পরে আইয়ুপ সুলতান মসজিদ বানানো হয়। এলাকাটি তার নামে পরিচিতি পায়। ১৭৬৬ সালে ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেলে ১৮০০ সালে তৃতীয় সুলতান সেলিম নতুন করে মসজিদটি বানিয়ে দেন। আবিষ্কারের পর থেকে হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) এর সমাধি বিশ্ব মুসলিমদের জন্য পবিত্র স্থান হয়ে ওঠে। পুণ্যার্থীদের ভিড় থাকে বছরজুড়ে।
ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে আয়ুপ জেলাতে এই ঐতিহাসিক সমাধি ও মসজিদ অবস্থিত। গত বছর তুরস্ক সফরে গিয়ে আমারও সুযোগ হয়েছিল সমাধিটি দেখার। সফল উদ্যোক্তা চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় সিমেন্ট উৎপাদক ডায়মন্ড সিমেন্টে লিমিটেডের পরিচালক লায়ন হাকিম আলীর নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের দলের বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ডিলার ও করপোরেট ক্লায়েন্ট। ১১ দিনের সফরের শুরুটাই হয়েছিল হজরত আবু আইয়ুব (রা.) মাজার জিয়ারত দিয়ে।
ইতিহাস বলছে, ৬২২ সালে হিজরতের পর মদিনা অবস্থানকালে নবীজীর (সা.) ঘনিষ্ঠ হন তিনি। ৬২২ সালে হিজরতের সময় মদিনা পৌঁছানোর পর শহরবাসী নবীজীকে (সা.) তাদের বাসায় থাকার অনুরোধ করেন। সিদ্ধান্ত হয় যে, নবীজীর উট যে বাড়ির সামনে থামবে সেখানেই থাকবেন তিনি। শেষপর্যন্ত উটটি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বাড়ির কাছে মাটিতে বসে পড়ে। নবীজী (সা.) তার বাসায় অবস্থান নিয়েছিলেন প্রায় ৭ মাস। প্রিয় নবীজীকে আতিথেয়তা, সম্মান সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি, এরপর এক দিনের জন্যও নবীজীকে (সা.) ছেড়ে যাননি।
সকালে ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ার থেকে টুরিস্ট বাসে রওনা হয় আমাদের দল। মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম শহরের শেষপ্রান্তে গোল্ডেন হর্ন জলপথের পাশে সমাধি এলাকায়। দূর থেকেই চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢালে সুঁচালো দুইটি সুন্দর মিনারসহ ওসমানীয় ঐতিহ্যে বানানো ধূসর রঙের আয়ুপ সুলতান মসজিদ, পাশেই সমাধি।
আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে ভালোবাসতেন বলে সামরিক ক্ষেত্রেই আইয়ুব আনসারির (রা.) কৃতিত্বটা সবচেয়ে বেশি। মুহাম্মদ (সা.) এর সময় থেকে মুয়াবিয়ার সময় পর্যন্ত মুসলিমদের এমন কোনো যুদ্ধ নেই যাতে তিনি অংশ নেননি। তিনি নবীজীর (সা.) সঙ্গে বদর, ওহদ, খন্দক, খাইবার, মক্কা ও হুনাইনসহ অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমরের (রা.) নির্দেশে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও সাইপ্রাসে। হজরত আলীর (রা.) পক্ষে অংশ নেন সিফফিনের যুদ্ধে। আলী (রা.) তাকে খুব ভালোবাসতেন, এমনকি যখন তিনি ইরাকে যেতেন, খলিফার দায়িত্ব তার কাছেই দিয়ে যেতেন। আলী (রা.)-এর সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে শিয়াদের কাছে আবু আইয়ুব (রা.) অনেক বেশি সম্মানিত।
মুসলিমরা মিশর জয় করার পর ৬৪২ সালে তিনি ফুসতাতে চলে যান এবং আমর ইবনুল আস মসজিদের পাশে বাড়ি বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। এসময় তার প্রতিবেশীদের মধ্যে ছিলেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম, উবাইদা, আবু যর, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস।
বাস থামে মাজারের পেছনের অংশের পার্কিংয়ে, গাইড মি. ইয়াসিরকে অনুসরণ করে আমরা ঢুকলাম সে পথ দিয়ে। পাথরের টাইলস বসানো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। চারপাশসহ পাহাড় টিলার ওপর পর্যন্ত পাথরে বাঁধানো শত শত নতুন-পুরোনো সমাধি। গাইডের বর্ণনা থেকে জানলাম, মহনবীর (সা.) সহচরের কাছাকাছি দাফনের আগ্রহ জানানো ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অনেক শাসক ও পরিবারের সদস্য এবং কর্তাব্যক্তি এখানে সমাহিত। সেই ধারায় বর্তমান তুরস্কের জনপ্রতিনিধি, বিচারক, আমলা, সামরিক কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে শায়িত ইস্তাম্বুলের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম এ কবরস্থানে। প্রতিটি সমাধির মাথায় প্রস্তরফলকে তুরস্ক ও আরবিতে লেখা মৃতব্যক্তির জীবনের গল্প। আগে দেখিনি মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল এত সুন্দর ও শৈল্পিক হতে পারে।
মার্বেল পাথরের গাঁথুনির অনেক উঁচু দরজা পার হয়ে ভেতরের চত্বরে ঢুকলাম। বর্গাকার চত্বরের একদিকে আয়ুপ সুলতান মসজিদ, বিপরীত দিকে হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) মাজার। চত্বরের মাঝখানে লোহার ঘেরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ। চত্বরজুড়ে স্থানীয়সহ বিশ্বের নানা জায়গার পুণ্যার্থীদের জটলা। সপ্তাহান্তে এবং ধর্মীয় ছুটির দিনে লোকে লোকারণ্য থাকে, ছুটি না থাকায় নিরিবিলি পরিবেশ পেলাম আমরা।
জিয়ারতের জন্য দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে প্রথমে ঢুকলাম মসজিদে। ভেতরের পুরো চত্বরজুড়ে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী গালিচা, দৃষ্টিনন্দন বিশাল ঝাড়বাতি, কারুকাজের গম্বুজ ও মিম্বার-অটোমন স্থাপত্যশিল্পের প্রতিচ্ছবি। পুণ্যার্থীদের কেউ নামাজে, কেউ তেলাওয়াতে মগ্ন। নামাজ শেষে গেলাম সমাধির দিকে।
দৃষ্টিনন্দন ইজনিক টাইলসে মোড়ানো সামনের বাইরের দেয়াল। বেশ সুন্দর। এসবে রয়েছে টুকরো টুকরো সিল করা লাল মোমের ধাঁচ। উইকিপিডিয়ার তথ্য, টাইলসগুলো তুরস্কের বাইরেও বেশ কিছু জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে, সম্ভবত ১৭৬৬ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রবেশ কক্ষ থেকে স্নানঘর পর্যন্ত দেয়ালগুলো একসময় এসবে ঢাকা ছিল।
বাইরে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করছেন অনেকে। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ছোট পরিসরের সমাধিকক্ষ, বিভিন্ন শতাব্দীর শিল্পিত লিপি, স্বচ্ছ ঝাড়বাতি এবং রূপালি কারুকাজে সাজানো। চকচকে রঙিন টাইলসে মোড়ানো চারদিকের দেয়ালের সাথে রং আর দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করছে কবরের প্রকোষ্ঠ। দেয়ালের নানা জায়গায় পবিত্র কোরআনের বাণীর চমৎকার ক্যালিওগ্রাফি। একপাশের দেয়ালে রূপালি ফ্রেমের বাক্সের ভেতর রাখা আছে মার্বেল পাথরের গায়ে খচিত মহানবীর (সা.) পায়ের ছাপসহ কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র। জানা যায়, অটোমেন যুগের প্রতিটি প্রজন্মের শাসক এবং অনেক দানশীল ব্যক্তি এই সমাধির অলংকরণ আর সৌন্দর্য বাড়াতে কাজ করেন।
রূপালি লিপিখচিত পাথরের সমাধির সামনে জেয়ারতে মগ্ন পুণ্যার্থীরা, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। নিচুস্বরে তেলওয়াত করছেন কয়েকজন। একবারে শান্ত পরিবেশ। নবীজীর ঘনিষ্ঠ সহচরের এত কাছে, জিয়ারতের সময় অন্যধরনের অনুভূতি হলো আমার। প্রশান্তিতে ভরে গেল মন-প্রাণ। তার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া শেষে বেরিয়ে আসলাম।
গাইড জানালেন, অটোমেন সুলতানদের সিংহাসনে আরোহণের উৎসবস্থল ছিল এই পবিত্র জায়গাটি। এখানেই নতুন সুলতানদের ওসমানীয় তলোয়ার দিয়ে বরণ করে নেওয়া হতো। অভিযান বা যুদ্ধে যাওয়ার আগে এখানেই সুলতানরা তাদের তরবারি শক্ত হাতে তুলে ধরার রেওয়াজ ছিল। আর এখন এই পবিত্র জায়গায় এসে দোয়া করে সংসার জীবন শুরু করাকে অত্যন্ত বরকতময় মনে করেন তুরস্কের নবদম্পতিরা। আরও রেওয়াজ আছে সুন্নতে খতনা করা তুর্কি বালকদের এখানে এসে দোয়া করার।
এরপর ঘুরে দেখলাম আশপাশ। মসজিদের পাশেই গাছ-গাছালি আর ফুলে ভরপুর সবুজ বাগানের মাঝে রান্নাঘর। অটোমেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমুতের সময় এখানে বিশাল চুলা আর পাত্রে রান্না করা হতো, বিধবা, বৃদ্ধ এবং এতিমদের বিনামূল্যে খাওয়ানোর জন্য। বাইরের উদ্যানে একদিকে গোলাকার ছাদ দেওয়া অজুখানা, স্থানীয় ভাষায় যাকে সাদির্ভান বলা হয়। আর তার সামনের দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারাটি পুরো এলাকাকে অন্যরকম সুন্দরে রূপ দিয়েছে।
ভেতরের মতোই সুন্দর ও শান্ত পরিবেশ বাজারে ঘেরা আশপাশ। ছোট ছোট দোকানে নানান রকম সুভেনিয়ার আর জিনিসপত্রে ঠাসা, তুর্কি ডিজাইনের ওড়না, হিজাব, বোরকা, জায়নামাজ, তসবিহ, কোরআন শরিফ, আতরসহ অনেককিছু। দোকানের প্লেয়ারে বাজছে তুর্কিশ ইলাহি সঙ্গীত আর হামদ-নাত, শুনে মুগ্ধ হতে হয়।
এরপর লম্বা সফরে তুরস্কের অনেক দর্শনীয় ও পবিত্রস্থানে গেলেও আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) সমাধিতে ভালোলাগার অনুভূতি মনে থাকবে আজীবন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক