জানলাম, কেনিয়া অত্যন্ত শুষ্ক একটি দেশ। এখানকার বেশিরভাগ ভূখণ্ডই গাছহীন, এ কারণেই সাদা রং।
এগুলো সরকার সংরক্ষিত এবং এখানেই গড়ে উঠেছে সাফারি পার্ক। বড় আকারের জলাভূমি এদেশে নেই বললেই চলে। পশ্চিমে সীমান্ত বরাবর আছে লেক ভিক্টোরিয়া (আহা, নামটা শুনলেই মন কেমন করে!) আর দক্ষিণে লেক তুরকানা। কিন্তু যেসব এলাকায় যাবো, সেখান থেকে দুটো লেকই বহুদূর। আফ্রিকা বলতেই গহীন জঙ্গল, সিংহ, চিতা আর সভ্যতার ছোঁয়া না পাওয়া আদিবাসীদের চেহারা ভেসে ওঠা মন তাই খানিকটা দমেই গেলো।
তারপরও মেঘের উপর মেঘ পাড়িয়ে একদিন ঠিকই পৌঁছে গেলাম জমো কেইনওয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। রাত তখন আটটা। এবার নাজিয়ার জন্য অপেক্ষার পালা। নাজিয়া বাঙালি, আমার অফিসের আমেরিকা শাখার সহকর্মী। আমেরিকা থেকে আগত ফ্লাইট ঠিকমতোই ল্যান্ড করলো, কিন্তু নাজিয়ার দেখা নেই। একা বিদেশ যাত্রা করে নিজেকে বেশ সাহসী মনে হচ্ছিলো। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সাহস কমতে শুরু করলো।
এদিকে দু’জন নারী ও পুরুষ ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকাল বাসের হেল্পারদের মতো আমাকে ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু রাতের কেনিয়া বিদেশিদের জন্য নিরাপদ নয়, তাই একা ট্যাক্সি চড়ার প্রশ্নই ওঠে না। সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রাত দশটার পর নাজিয়ার দেখা পেলাম। নাইরোবি শহরে উবার খুব জনপ্রিয়। কল দিতেই গাড়িও পেয়ে গেলাম। হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার কয়েক মিনিট পরেই দেখি রাস্তার পাশে আধো-অন্ধকারে তিনটে জেব্রা ঘাস চিবুচ্ছে! বুঝলাম কেনিয়া সফর ভালোভাবেই শুরু হতে যাচ্ছে!
নাইরোবিতে আমাদের আবাসস্থল ফেয়ারভিউ হোটেল। পুরো হোটেল জুড়ে আছে গাছ-গাছালি আর তাদের রং-বেরঙের ফুল। কয়েকটা নান্দনিক নিচু ইটের দালান, চারটি রেস্টুরেন্ট, সুইমিং পুল আর অবিরাম বয়ে চলা কৃত্রিম ঝরনা- সব মিলিয়ে ফেয়ারভিউ-ই বটে। কাজের প্রয়োজনে আগত ভিনদেশি কর্মজীবী মানুষের পছন্দের গন্তব্যস্থল এটি।
প্রাকৃতিক পরিবেশে অফিসের কাজ করার এরকম সুব্যবস্থা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। পাশেই গড়ে উঠছে বিশাল বহুতল হোটেল। চাইলেই হোটেল কর্তৃপক্ষ এখানেও আধুনিক বহুতল ভবন গড়ে তুলতে পারেন, কিন্তু তারা তা করেননি। বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
সাজানো-গোছানো সুন্দর পরিকল্পিত শহর নাইরোবি। ঝকঝকে রাস্তার দু’ধারে ফুলে ঢাকা গাছ, সুন্দর দালান-কোঠা-স্থাপত্য। তবে এখানকার যানজট অসহনীয়। রাস্তার পাশে ছিন্নমূল মানুষও চোখে পড়লো।
নাইরোবির বাসিন্দারা পোশাকে পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ করে। টিভিতে দেখলাম সোহেলি (কেনিয়ার জাতীয় ভাষা) ডাবিংয়ে হিন্দি সিরিয়াল চলছে। তাদের নিজস্ব টিভি সিরিয়ালগুলোও হিন্দি সিরিয়ালের নকল, সেখানে সুন্দরী মেয়েরা সারাক্ষণ একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে!
নাইরোবিতে যে সাতদিন ছিলাম তার মধ্যে মাত্র একদিন ঘোরার সুযোগ পেলাম। জাতীয় জাদুঘর দেখতে গিয়ে হতাশই হলাম। ক্যামিকেল দিয়ে সংরক্ষণ করা পশু-পাখি এবং আফ্রিকায় আবিষ্কৃত মানব ও তার পূর্বপুরুষের কংকাল দিয়েই পুরোটা সাজানো। আফ্রিকার সমৃদ্ধ আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতি এখানে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
সেদিন বিকেলে গেলাম মাসাই মার্কেট। এটি মূলত ভাসমান মার্কেট, একেক দিন একেক এলাকায় বসে। এখানে মাসাই সম্প্রদায় হাতে তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে। এর আগে দু-একটা দোকানে ঢুঁ মেরে পণ্যের দাম শুনে মাথা ঘুরে গেছে। তাই খুব আশা নিয়ে সেখানে গেলাম। নাজিয়ার বদৌলতে আশা পূরণও হলো। মার্কেটজুড়ে কাপড়, পুঁতির গহনা, ব্যাগ, স্যান্ডেল, পাথর কেটে বানানো রং-বেরঙের তৈজসপত্রের সমাহার।
দোকানিরা আধো ইংলিশে যে যার মতো দাম বলছে। তারা যে দাম বলছে নাজিয়া বলছে তার অর্ধেকেরও কম। অনেক মুলোমুলির পর নাজিয়ার বলা দামেই অধিকাংশ পণ্য কেনা হলো! নাইরোবিতে আরেকটা জিনিস মন ভরে উপভোগ করেছি। তা হলো খাবার। আমরা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের খাবার খেয়েছি।
উহ! যেমন স্বাদ সেরকম পরিমাণ, খেয়ে শেষ করা যায় না। তখন জানা ছিল না খাবার নিয়ে কী ভয়ানক দুর্গতি সামনে অপেক্ষা করছে। সেই গল্পও বলতে চাই, তবে আজ নয়, পরের পর্বে।
চলবে….
বাংলাদেশ সময়: ০১২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৭
এএ