আরুঘাট মূলত নেপালের দার্দিং এবং গোর্খা জেলার মাঝে পড়েছে। যারা মানাসলু অঞ্চলের পর্বত অভিযানে আসেন অথবা মানাসলু সার্কিট ট্রেকিং করতে আসেন তাদের এখান থেকে হাঁটা শুরু করতে হবে।
প্রার্থনা করছিলাম বৃষ্টি যাতে না নামে। এই রাস্তায় বৃষ্টি নামলে আর আরুঘাট যেতে হবে না। অবশ্য আকাশজুড়ে জলন্ত সূর্যের রাজত্বও যে খুব সুবিধা করেছে তা বলবার উপায় নেই। ধুলোর অত্যাচার কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহ্য করবার জন্যও একবার অন্তত এই রাস্তায় সবার আসা উচিত।
রাস্তার পাশের ধূলি ধূসরিত জনপদ। কিন্তু মনে কেড়ে নিলো পাহাড়ের গায়ে ধাপকাটা ফসলের ক্ষেত। এখন ধানকাটার সময়। সোনালি পাকা ধান পাহাড়ের উপত্যাকার সর্বত্র রঙের ছটা লাগিয়েছে। ছেলে বুড়ো বিশেষ করে নারীরা ব্যস্ত ফসল কাটা, মাড়াইয়ে। এ যে ঠিক আমার বাংলার রূপ। পার্থক্য শুধু পথের বিশাল বিশাল সব চড়াই উৎরাইয়ে। আমাদের বাস ইঞ্জিনে ভয়াবহ গো গো শব্দ তুলে সে সব প্রাণান্ত চড়াই ভাঙছে, নামতে হচ্ছে অনেক সন্তর্পণে। একবার ব্রেকফেল করলে সেখানেই চির সমাপ্তি।
এর মধ্যেই নূর ভাই ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সিটে বসে কি করে ঘুমাচ্ছেন আল্লাহ-ই জানেন। মুহিত ভাই, বিথী, শাকিল ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে সেই কখন থেকে মুখে কাপড় গুঁজে বসে আছে। কারও মুখে রা নেই। বিপ্লব ভাই কখনো ঘুমাচ্ছেন, কখনো জেগে। আমি বসে বসে চারপাশ দেখছি আর ধুলো গিলছি। এর ফল আমাকে ভোগ করতে হয়েছে গোটা অভিযানে।
আমরা চলেছি এজেন্সির ভাড়া করা বাসে। কেউ যদি কাঠমান্ডু থেকে সরাসরি আরুঘাট যেতে চান পাবলিক বাসে তার জন্যও ব্যবস্থা আছে। কাঠমান্ডুর মাছাপোখারি বাসস্ট্যান্ড থেকে দিনে চারটি বাস ছেড়ে যায় আরুঘাটের উদ্দেশ্যে। আপনি যদি সেসব বাস ধরতে চান তবে আপনাকে আগেই বুকিং দিয়ে রাখতে হবে। কারণ এসব বাসের আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। আমরা আরুঘাটের যত কাছে আসছিলাম মুহিত ভাই স্মৃতি হাতড়ে পুরনো দিনের কথা বার করছিলেন।
এর আগে তিনি দু’বার এই এলাকায় এসেছেন মানাসলু অভিযান করতে। প্রথমবার ২০০৮ সালে। পরেরবার ২০১১ সালে মানাসলুতে ওড়ান লাল সবুজ পতাকা। পথে এক পর্যায়ে বুড়িগন্ধাকী নদী আমাদের সঙ্গী হলো। পরবর্তী দিনগুলোতে একেবারে সামদো অবধি এই নদীর উজান ধরে আমরা উপরের দিকে উঠেছি। চড়াই-উৎরাই ছেড়ে একেবারে সমতল মালভূমির মতো এক জায়গায় উপস্থিত হলাম। ঠিক আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মতো পরিবেশ। ক্ষেত, খামার, মানুষের বসতভিটে।
সেই সমতল ছেড়ে আরও নিচের দিকে নামতেই অবশেষে দেখা পাওয়া গেলো আরুঘাটের। আমরা মূল বাজার থেকে কিছুটা আগেই থামলাম। সেখানে হোটেল পাওয়া গেলো না বলে মূল জনপদে ঢুকতেই হলো। বুড়িগন্ধাকী আরুঘাটকে বিভক্ত করেছে। মাঝখানে দড়ির সাসপেনশন ব্রিজ। আমরা সাতকার লজে উঠলাম। গোসলে ধুলোয় একাকার শরীর হালকা হলো ঠিকই কিন্তু ঠান্ডা, সর্দি-কাশির অশনি সংকেত বাজিয়ে দিলো। জানা গেলো সকালের পরিষ্কার আকাশে এখান থেকে গনেশ হিমালয় রেঞ্জ দেখা যায়।
কিন্তু আমার পুরো মন জুড়ে তখন দুটি-ই নাম মানাসলু আর লারকে। বিকেলে বাজার ঘুরতে বেরোলাম। এখানে মূলত গুরুঙ্গ জনগোষ্ঠীর বাস। নেপালের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল এ এলাকা। তার ছাপ বাড়িঘরের ফাটল চিহ্নে স্পষ্ট। সামনে দীপাবলী, রং বিক্রি চলছে। বেশি রাত করলে চলবে না আমাদের। কাল ভোর থেকেই শুরু আসল ট্রেকিং। রাতের খাবারে নেপালি থালি। চিকেন, ডাল, সবজি আর সেই রাই শাক। তারপর ঘুমে ঢলে পড়ল আমাদের আরুঘাটের রাত। কাল থেকে ট্রেকিং....!
চলবে….
** এক টুকরো আফ্রিকা (পর্ব-১)
** হিমালয়ের মানাসলু ট্রেকিংয়ের অদম্য নেশায় যাত্রা (পর্ব-১)
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৭
এএ