সাত সকালেই খুলে গেছে দোকানপাট। বেরিয়ে পড়েছে মানুষ জীবনের প্রয়োজনে।
আরুঘাট বাজার পার হয়ে বড় রাস্তা ধরে আমরা চলেছি আরক্ষেত বাজারের দিকে। গায়ের বড় মেঠোপথের মতো। এ রাস্তা ধরেই ট্রাক-বাস চলছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগন্ধাকী। ওপারে পাহাড়ি উপত্যাকার প্রান্তরে ফসল কাটার আয়োজন।
এক ধরনের বান্দরবান বান্দরবান গন্ধ চারিদিকে। আরও অনেক বিদেশি ট্রেকার দল চলেছে সামনের দিকে। কোথায় যেন বাঁধনহারা সুর বেজে চলেছে চরাচর জুড়ে। গনেশ হিমাল রেঞ্জ এখন অনেক স্পষ্ট। উচ্চতা একই রকম হলেও চারপাশের পাহাড়গুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের পাহাড়গুলোর বেশ পার্থক্য। একটা পাথুরে রুক্ষতা আছে তাদের শরীরজুড়ে। আমরা আপন মনে হাঁটছি। এভারেস্ট অঞ্চলের পর্বতাভিযানের চেয়ে অন্নপূর্ণা কিংবা মানাসলু অঞ্চলের পর্বতাভিযানের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। এভারেস্ট অঞ্চলে ট্রেকিং শুরু হয় লুকলা থেকে ৯ হাজার ফুট উপর থেকে। আর আমরা শুরু করছি প্রায় বাংলাদেশের সমমানের উচ্চতা থেকে। ফলে অল্টিচিউডের সঙ্গে শরীরকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার ঢের সময় আমরা পাবো। এক দিনে সর্বোচ্চ উচ্চতা পাঁচশো মিটারের বেশি নয়।
আমাদের আজকের গন্তব্য লাপুবেসি। মাঝে আরক্ষেত বাজার পার হয়ে দুপুরের মধ্যাহ্ন বিরতি দেওয়া হলো সতীখোলায়। এ পর্যন্তই গাড়ি চলাচলের পথ শেষ। এরপর সামনে এগোতে চাইলে পদযুগলই ভরসা। আমরা একটি লজে খাবারের অর্ডার দিলাম। চিকেন, সবজি, ডাল-ভাত। প্রথম কয়েক ঘণ্টার ট্রেকিং, তার উপর বেজায় গরম। কিছুটা ক্লান্তি চলে এসেছে। এখানকার অসাধারণ মিষ্টি সুপেয় পানি এক নিমিষে তা দূর করে দিলো। খাবারের সঙ্গে ভুটানি ড্রুক আমের আচার দারুণ জমলো।
তারপর আবার ট্রেকিং শুরু করলাম। এরপর লাপুবেসি পর্যন্ত পুরো রাস্তাজুড়ে নানা জায়গায় বিভিন্ন আকৃতির অসাধারণ সব ঝরনা চোখে পড়লো। খোরসানী বাড়ি বলে এক জায়গায় ঝরনাটি এতোই পছন্দ হয়ে গেলো যে আমি নূর ভাই আর শাকিল রাস্তার পাশে এক লজের খোলা চত্বরের ঘাসে শুয়ে বসে ঝরনার রূপ দেখা আর ছবি তুলে নিলাম। আমরা এখন যে অঞ্চলে আছি তাকে লোয়ার মানাসলু বলে। চারপাশের গাছপালার শ্রেণী বিন্যাসের সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের গাছপালা পরিবেশ প্রতিবেশের বেশ মিল রয়েছে। চারপাশের পাথুরে রুক্ষতাতেই যা অমিল। কোথাও কোথাও রাস্তা বানানোর কাজ চলছে। এক জায়গায় নেপালি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পও চোখে পড়লো।
রাস্তা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছে। বুড়িগন্ধাকী অনেকটা নিচে। কিন্তু তার গর্জনের কোনো বিরাম নেই। তিব্বত থেকে বরফ গলা পানি বয়ে নিয়ে পথে অসংখ্য ঝিরি ঝরনার মিলনে সে হয়েছে আরও স্রোতস্বীনি বেগবান। র্যাফটিংয়ের ব্যাপারে নূর ভাইয়ের কিছুটা জ্ঞান আছে। তিনি জানালেন এর কোনো কোনো জায়গা র্যাফটিংয়ের তাত্ত্বিক ভাষায় লেভেল থ্রি, মানে বেশ বিপজ্জনক।
আমরা পর পর দু’টি বিশাল চড়াই ভেঙে অবশেষে লাপুবেসির দেখা পেলাম। গুরুঙ্গ জনগোষ্ঠীর বাস এ গ্রামে। সেখানকার এক লজে থাকার ব্যবস্থা। পাকা দালানের দোতলার তিনটি ঘরে আজ আমাদের রাতের ঠাঁই। গোসল করে ছাদে বেশ আড্ডা হলো। অনেক কসরত করে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া গেলো। শেষবারের মতো যে যার বাড়িতে কথা বলে নিলো। এরপর আর আমাদের সঙ্গে থাকা এনসেলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না।
**ধুলোবালি গিলতে গিলতে ট্রেকিং শুরুর আরুঘাট (পর্ব-৩)
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৭
এএ