দিগন্ত বিস্তৃত গ্রেট রিফট ভ্যালি, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির পাহাড় দেখলাম। পাহাড়ের উপরে, থম্পসন ফলসের পাশে বসে চমৎকার রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেলাম।
সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অনেক পরিবার বেড়াতে এসেছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা চাদর বিছিয়ে পাহাড়ের ঢালে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে। অল্প বয়স্করা অ্যাডভেঞ্চারে মেতেছে। বিপদজ্জনক পাহাড়ি পথ বেয়ে তারা নিচে নামছে ঝরনা থেকে উৎপন্ন পাহাড়ি নদীতে পা ভেজাবে বলে। কিউসোর কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছিল। একই দেশের দু’টো এলাকার প্রকৃতি কি ভীষণ রকমের ভিন্ন।
মারালালের কাছাকাছি পৌঁছে বুঝতে পারলাম জাতীয় সংরক্ষিত এলাকায় চলে এসেছি। রাস্তার দু’পাশে গরু, উট আর জেব্রা চরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ বাঁদরের দলের দেখা মিলছে। যেখানে জলাশয় আছে সেখানে হরিণ, জেব্রা, হাঁস আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মেলা বসেছে।
লিশান বললেন, এই এলাকায়ও নাকি বৃষ্টি কম হয়েছে। অধিকাংশ জলাশয়েই পানি নেই, পশু-পাখি তুলনামূলক ঠাণ্ডা এবং বেশি পানি পাওয়া যায় এরকম এলাকায় চলে যাচ্ছে। মারালালের প্রকৃতি, এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী, তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও সাজ সবই ভীষণ সুন্দর। হোটেলের মান ভালো, রয়েছে ২৪ ঘণ্টার ওয়াইফাই সেবা। খাবারও চমৎকার। তবে আদিবাসীদের জীবনমান কিউসো এলাকার অতিদরিদ্র মানুষদের মতোই যা আগের পর্বে বর্ণনা করেছি।
কেনিয়া ভ্রমণের শেষ আকর্ষণ ছিল সাফারি করা। আমরা যখন সাম্বুরু গেম লজে পৌঁছি তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। এলাকাটা মূলত সমতল, দু’ধারে ঝোপ-ঝাড় আর ছোট-বড় গাছের সারি। দূরে টিলা দেখা যাচ্ছে। এই সংরক্ষিত এলাকায় প্রাণীরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। লজের গেট থেকে মূল ভবনে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। এই সময়েই একটা মিনি সাফারি হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় কয়েকটা ডিগডিগ (ছোট্ট আদুরে হরিণ) আর একটা হুতুম পেঁচা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না।
ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় লজ থেকে সারাদিনের উচ্ছিষ্ট খাবার সংলগ্ন পাহাড়ি নদীর তীরে ফেলা হয়। কুমিরের দল সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করে। তাদের হাড় চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য নাকি দেখার মতো। দেরিতে পৌঁছানোয় সেটিও মিস করলাম। তবু মন ভরে দিল পাঁচ তারকা লজের সাজসজ্জা। এতবড় একটা লজ, প্রকৃতির মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। লবি, খাবার ঘর তৈরিতে প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন: কাঠ, বাঁশ, খড়ের ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে হালকা আলো আর বাহিরে গাঢ় অন্ধকার। চারপাশ নিঃশব্দ, কেমন যেন আদিম, গা ছমছম ভাব।
বিশাল আকৃতির চাঁদ নদীর উপর আলো ছড়াচ্ছে। একটু এগোলে একটা পর একটা কটেজ। এগুলোতেই অতিথিরা থাকেন। রাত বারটার পর কোনো ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না, ফোন বা ওয়াইফাই সংযোগ নেই। সারা রাত পাহারাদাররা হেঁটে বেড়ায়। রাতে কটেজ থেকে বের হওয়া যাবে না, কোনো প্রয়োজনে লবিতে যেতে হলে পাহারাদারদের সাহায্য নিতে হবে, নইলে লেপার্ড বা চিতার রাতের খাবারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে!
দরজা ভাল করে বন্ধ রাখতে হবে নইলে দুষ্টু বানরের দল হামলা করতে পারে। গভীর জঙ্গলে এই বিশাল কটেজে আমাকে একা রাত কাটাতে হবে, মনে মনে বললাম, একেই বলে Truly Africa’!
নৈশভোজের সময় জেকোবের সঙ্গে পরিচয় হলো। সে এই অঞ্চলের অন্যতম সাফারি ট্যুর গাইড। ঠিক হলো পরের দিন সকাল সাড়ে ছয়টায় আমরা বের হবো। দু’ঘণ্টা সাফারি করবো। সকাল ছয়টায় (আমাকে বলা হয়েছিল ভোরে লজ এলাকায় একা চলা নিরাপদ) নদীর ওপারে সূর্যোদয় দেখলাম।
কিচিরমিচির করে বানর আর হনুমানের দল সুপ্রভাত জানালো। সাফারি সত্যিই এক দারুণ অভিজ্ঞতা। গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে জিরাফ, বানর, হনুমান, জেব্রা, হাতি, বন্য শুয়োর, অস্ট্রিচ, কয়েক প্রজাতির পাখি ও হরিণ দেখলাম। অনেকগুলো গাড়ি পুরো এলাকা চষে বেড়াচ্ছে। ট্যুরিস্টরা এক বিন্দুও শব্দ করছে না। গাইডরা ফিসফিসিয়ে প্রাণী চেনাচ্ছে। একটা সিংহিরও দেখা পেলাম!
খাবারের খোঁজে বের হয়েছে। সে যেখানে যাচ্ছে, নিঃশব্দে আমাদের গাড়িও তাকে অনুসরণ করছে। সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে লেপার্ড বা চিতার দেখা পেলাম না। খরায় গাছপালা জ্বলে যাওয়ায় জঙ্গল ফাঁকা হয়ে আছে, তাই লেপার্ড বা চিতা মানুষের সাড়া পেলে সহজে ডেরা থেকে বের হয় না। তারপরও যা দেখলাম তাতেই নিজেকে ধন্য মনে হলো।
দু’সপ্তাহের বিরামহীন ভ্রমণ আফ্রিকার প্রাণিসম্পদ আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সভ্যতাকে ভালোবাসা জানিয়ে সমাপ্ত করলাম। ক্লান্ত আমার কানে কে যেন তখন অবিরাম গেয়েই চলেছে ‘ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে’।
উপমা মাহবুব
উন্নয়ন কর্মজীবী
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৭
এএ