হঠাৎ জনি বলে উঠলো, কাল তো শুক্রবার, তাই না?
- হুম্। তো ?
- আজ রাতের ট্রেনে সীতাকুণ্ড গিয়ে কাল চন্দ্রনাথ পাহাড় আর গুলিয়াখালী ঘুরে আসলে কেমন হয়?
- এখন! আমার সাথে ক্যামেরা নেই।
- বাসায় গিয়ে নিয়ে আয়।
- মাথা ঠিক আছে! এখন বাসায় গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে আসতে গেলে ট্রেন মিস হবে।
- আরে দেরি আছে এখনো ট্রেনের। হুট করে না গেলে আর যাওয়াও হবে না। সব কিছুই কি প্ল্যান করে করতে হবে নাকি? আমি দ্রুত কিছু কাজ সেরে কমলাপুর চলে আসছি।
এভাবে কোনো প্ল্যান-প্রোগ্রাম ছাড়াই হুট করে ট্রেনে চেপে রওনা দিলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে।
কিন্তু যাওয়ার সময় ঘটলো বিপত্তি। কমলাপুর পৌঁছে দেখি যে ট্রেনে যাবার কথা ছিল সেটা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এদিকে জনি এখনও আসেনি। প্লাটফর্মে বসে রাগে গজ্ গজ্ করতে থাকলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর এলেন নবাবজাদা। চট্টগ্রামগামী শেষ ট্রেন ‘তূর্ণা নিশিতা’ তখন প্লাটফর্মে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ট্রেন সীতাকুণ্ড থামে না। হয় চিটাগাং নামতে হবে নইলে ফেনী। যা আছে কপালে, ভেবে স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে উঠে পরলাম, ফেনীতে নেমে বাকিটা নিয়ে ভাবা যাবে। ফেনী পৌঁছলাম ভোররাতে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেইলে চেপে সকাল সকাল সীতাকুণ্ড।
সীতাকুণ্ডে আমাদের সাথে যোগ হলো আরেক ট্রাভেলার বন্ধু ডা. সোহান (আমার ব্যক্তিগত দন্ত চিকিৎসকও তিনি)। তাকে সাথে নিয়ে রওনা দিলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে। অটো নামিয়ে দিলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। প্রতিদিন এখানে আরাধনা করতে আসে শত শত সনাতন ধর্মাবলম্বী। পাহাড়ে ওঠার সময় আমাদের সাথে দেখা হয় একটা সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের। তাদের সাথে ৪ বছরের একটি শিশু। এইটুকু একটা শিশু কারো সাহায্য ছাড়াই তড়তড় করে বড় বড় সিঁড়ি বেয়ে যাচ্ছে, দেখে অবাক না হয়ে উপায় নেই।
কিছুদূর ওঠার পরে একটা দোকান দেখতে পেলাম। পেয়ারা, গাব, কলাসহ বিভিন্ন খাবারের পসরা সেখানে। পেয়ারার লোভ সামলাতে না পেরে নিয়ে নিলাম কয়েকটা। সত্যি কথা বললে, এমন মজার পেয়ারা কখনও খেয়েছি কিনা সন্দেহ। গন্ধে-স্বাদে অন্যরকম একটা বুনো স্বাদ।
আরও কিছুদূর এগোলে একটা ঝর্না চোখে পরল। সেখানে একটু ফ্রেশ হয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। যতোই ওপরে উঠছি চারপাশের ভিউ ততোই সুন্দর হতে লাগলো। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়। যতদূর চোখ যায় ততোদূর পর্যন্ত শুধুই সবুজের রাজ্য। দিগন্তরেখা বরাবর ধোঁয়াশার মতো সমুদ্রও ধরা দিলো চোখে। মনে পরে গেল ছোটবেলায় দেখা ‘আলিফ লায়লার’ সেই ঘটনা, যেখানে এমন ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে অন্য এক জগতে চলে যায় সবাই। প্রবল আকর্ষণে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল যেন তা।
কিছুক্ষণ চলল ফটোসেশন পর্ব। এবার নামার পালা। আবার দেখা হয়ে গেল সেই শিশুটার সাথে যাকে আমরা উঠার সময় দেখেছিলাম। কথা বলে জানতে পারলাম পুরো পথই নাকি কারো সাহায্য ছাড়াই হেঁটে উঠেছে সে। নামার সময় বিপত্তি সৃষ্টি করলো বৃষ্টি। আশ্রয় নিলাম সেই পেয়ারার দোকানে। আবার চলল পেয়ারা আর পাহাড়ি কলা খাওয়া পর্ব। বৃষ্টি থামলে নেমে এলাম নিচে। অটোতে করে চলে গেলাম সীতাকুণ্ড বাজার। ডাক্তার বন্ধু সোহানের অন্য কাজ থাকায় আমাদের গুলিয়াখালীর সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো।
তখন মধ্য দুপুর। জোয়ার চলছে। সাথে প্রচণ্ড গরম। গুলিয়াখালীতে একটা পুকুরে গোসল সেরে লাঞ্চ করে একটা গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে থাকলাম। ট্রলারে করে বিচে যাওয়া যায়। কিন্তু গরমে অস্থির অবস্থা তখন। তাই আর গেলাম না। ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাটা চলে এলে হেঁটে চললাম গুলিয়াখালীর বিচের দিকে। পিচ্ছিল কাঁদায় পরিপূর্ণ পুরো পথ। হাঁটতে খুব ভয় করছিল। তাই খুব সাবধানে হাঁটতে হলো।
সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়ানো চারপাশ। সবুজ গালিচার মাঝে মাঝে পানিভর্তি প্রাকৃতিক বাথটাবের মধ্যে খেলা করছে ছোট ছোট মাছ। শরতের মেঘমুক্ত আকাশ সাথে সবুজ ঘাস দেখতে দেখতে রওনা দিলাম বাসবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যাটা কাটালাম সেখানেই। কয়েকজন পর্যটক মারা যাওয়ার পর থেকে পানিতে নামা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কথা হয় কয়েকজন জেলের সাথে, তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে। ছোট্ট ট্রলারে করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা মাছ ধরতে যায়। ফিরে আসে মধ্যরাতে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে তারা। অসুস্থ হলেও থেমে থাকার উপায় নেই। সন্ধ্যা নেমে এলে জেলেদের জীবনসংগ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে রওনা দিলাম ঢাকার পথে। হাজারটা কাজ ফেলে হুট করে এখানে এলেও আফসোস রইলো না একটুও। ফেরার পথে মনে হচ্ছিল আরেকটু থেকে যেতে পারলে চারপাশটা আরও ভালোভাবে দেখে যেতে পারতাম। তবে সান্ত্বনা এই ভেবে যে, কেবল একদিনের ছুটিতেই খুব সহজে চন্দ্রনাথ-গুলিয়াখালী থেকে ঘুরে-আসা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮
এনএইচটি