ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বুনো ঝরনার খোঁজে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮
বুনো ঝরনার খোঁজে হাম হাম ঝর্না। ছবি: বাংলানিউজ

তারিখ যতোই ঘনিয়ে আসে ট্যুরের মেম্বার ততোই কমতে থাকে, ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে কথাটা প্রবাদতুল্য। ১২ থেকে ১৪ জন নিয়ে ট্যুর প্ল্যান দাঁড় করানো হয়। শুরুতে সবাই আগ্রহ দেখালেও শেষপর্যন্ত সেটা পাঁচ জনে গিয়ে নামে। বাকি মেম্বারদের নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা না করে এই পাঁচ জন সৌভাগ্যবান রওনা দিলাম বুনো ঝরনার খোঁজে ‘হাম হাম’-এর উদ্দেশ্যে।

রিপোর্টিং প্লেস গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে। যথাসময়ে চলে আসলাম সবাই।

দিনটি বৃহস্পতিবার হওয়ায় সব গাড়িতেই প্রচণ্ড ভিড়। বাস ধরতে হবে সায়দাবাদ থেকে। খালি রিকশাও নেই। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে উঠে পরলাম একটা ভ্যানে।

ভ্যানে করে ওয়ারী পর্যন্ত আসতেই পাশ থেকে আরেকটি ভ্যান এসে আমার পায়ে চাপা দিলো। মুহূর্তের জন্য মনে হলো আজ বুঝি ঘুরতে যাওয়ার বদলে হাসপাতালে যেতে হতে পারে। পা না ভাঙলেও প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তবে বাকি সবার ট্যুরের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে ভেবে কাউকে এ ব্যাপারে বুঝতে দিলাম না। কোনো মতে সায়দাবাদ পৌঁছে শ্রীমঙ্গলের বাসে উঠে পরলাম।

খুব ভোর থাকতেই পৌঁছে গেলাম শ্রীমঙ্গল। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে পুরো দিনের জন্য সিএনজি ভাড়া করে রওনা দিলাম হাম হামের উদ্দেশ্যে।  

হাম হাম যাওয়ার পথে।  ছবি: বাংলানিউজ
আমাদের সিএনজি চলল গ্রাম, বিল, মাঠ আর বন-জঙ্গল পেরিয়ে লাউয়াছড়া উদ্যানের মধ্যদিয়ে। একসময় তৈইলংবাড়ি এসে আমরা চা বিরতি দিলাম। তিন টাকা করে চা। খেতে মন্দ না। সেখানে আমাদের সাথে যোগ দিলেন সাইফুল ভাইয়ের পরিচিত আরও চার ট্রাভেলার। গাইড মামুনকে আমাদের ঘুরিয়ে আনার জন্য ঠিক করলাম। গাইডসহ আমরা পৌঁছলাম চাম্পা রায় চা বাগান। সেখান থেকে হাঁটতে হবে। গাইড জানালেন, পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে যেতে হবে আমাদের।

কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও আবার পার হতে হচ্ছে সাঁকো। ঝিরিপথের কোথাও কোথাও অত্যন্ত পিচ্ছিল। পাথরে শেওলা জন্মে এমন পিচ্ছিল হয়েছে সেগুলো। খুব সাবধানে হাঁটতে হলো। গাইড জানালেন, প্রথমে আমরা সিতাপ ঝরনা দেখতে চলেছি, এরপর হাম হাম।

হাম হাম যাওয়ার পথে বুনো পাহাড়ি ঝিরিপথ।  ছবি: বাংলানিউজ

হাম হাম মূলত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। এ জঙ্গলে নাকি একসময় চিতাবাঘ বাস করতো। তাই স্থানীয়দের কাছে এটি ‘চিতা ঝরনা’ নামে পরিচিত। সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলে একসময় অনেক রকম বন্যপ্রাণীর বসবাস থাকলেও এখন এদের সংখ্যা অনেক কম। সম্প্রতি এখানে ২টি মেছোবাঘ অবমুক্ত করা হলেও পরে সেগুলোকে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে বলে জানায় গাইড মামুন।

এরকম আরও অনেক গল্প শুনতে শুনতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম সিতাপ ঝরনায়। ঝরনার ঠাণ্ডা জলে বেশ কিছুক্ষণ গোসল করে রওনা দিলাম হাম হামের দিকে। আবার পাহাড়ি ঝিরিপথ পথ, যেতে যেতে শুনতে পেলাম ঝরনার ‘কল্‌’ ‘কল্‌’ শব্দ।  

সিতাপ ঝর্না।  ছবি: বাংলানিউজ

হাম হাম পৌঁছে ঝরনার ঠাণ্ডা পানিতে আবারও গা ভিজিয়ে নিলাম। কিন্তু সেখানে খুব বেশি সময় পাওয়া গেল না হাতে। এদিকে আকাশেও মেঘ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরার পথে পা বাড়াতে হলো।  

ফেরার সময় পড়তে হয় ঝুম বৃষ্টিতে। ক্যামেরা/মোবাইল পলিথিন মুড়িয়ে বৃষ্টির মাথায় নিয়েই হাঁটতে থাকি। যাওয়ার সময় জোকের উপদ্রবে না পড়লেও এবার তারা ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ শুরু করলো।  

হরর মুভির রক্তপায়ী ড্রাকুলার মতোই ভয়ংকর মনে হতে লাগলো এই প্রাণীগুলোকে। গাছের পাতায় পাতায় লেগে থাকা জোকের হাত থেকে কেউ নিস্তার পেলাম না। উপর-নিচ-ডান-বাম-সামনে-পেছনে সবদিক থেকে আক্রমণ আক্রমণ করতে থাকলো। এদিকে বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি পথ কাঁদায় পিচ্ছিল যাওয়ায় এগুনো আরও কষ্টকর হয়ে গেল। কিছু কিছু যায়গায় পা পিছলে গেলেই পড়তে হবে ৩০/৪০ ফুট নিচে।  

পাহড়ি ঝিরিপথ।  ছবি: বাংলানিউজ

জঙ্গলের এ গাছ থেকে ওগাছে ছুটোছুটি করছে চশমা পরা হনুমান। প্রবল বৃষ্টিতে তারাও খানিকটা ভীত বলে মনে হলো।

একসময় আমরা চলে এলাম কলাবন পাড়ায়। এরপর গাইডের বাসায় গোসল। ফেরার সিএনজিতে যখন উঠলাম, তখন সন্ধ্যা নেমে রাত। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পার হলাম রাতের অন্ধকারে। পথে আমাদের সামনে পড়ে কয়েকটা শেয়ালের পাল। আমাদের গতিবিধির ওপর নজর বুলাচ্ছিল তারা। পেছনের গভীর অন্ধকারে বন্য শেয়ালের পাল ফেলে এগিয়ে যেতে থাকি ঢাকার উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮
এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।