ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের ছোট্ট শহর নিউকে। এটি কর্নওয়াল কাউন্টিতে অবস্থিত, যা উত্তর আটলান্টিকের একটি উপকূল।
গরমের ছুটিতে যখন বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটি মনোরম সাগর সৈকতের খোঁজ করছিলাম তখন ইন্টারনেট ঘেঁটে আর বন্ধুদের মুখে বর্ণনা শুনে নিউকের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
ইংল্যান্ডের আবহাওয়াকে বিশ্বাস করা যায় না, এই ভালো তো এই খারাপ, তা হোক না শীত কিংবা গ্রীষ্ম। একদিন সকালে পরিষ্কার আকাশ আর ঝকমকে রোদ দেখে বেরিয়ে পড়লাম। লন্ডন থেকে সেই শহর ২৭ মাইল দূরে, গাড়িতে যেতে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা তো লাগেই। তাতে অসুবিধা নেই, আমার সঙ্গী গাড়ি চালাতে ভালোবাসে, সে হাঁপিয়ে গেলে আমি তো আছিই।
শহরের ঠাসবুনোট ভিড় ছেড়ে গাড়ি মোটরওয়েতে পড়লো, পেরিয়ে গেলাম একের পর এক গ্রাম, প্রান্তর, ফসলের মাঠ। ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইড দেখার মতো সুন্দর…। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ বা ফসলের ক্ষেত, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দুটো ঘরবাড়ি, মাঝে মধ্যে ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে নদী, চরে বেড়ানো ভেড়ার দল, কখনো দেখতে পাওয়া যায় বহুদূরের কোনো গির্জার চূড়া- কোনটাকে ছেড়ে কোনটাকে সুন্দর বলবো!
যা হোক দুপুর সাড়ে তিনটা নাগাদ পৌঁছলাম, একেবারে হলিডে লজের দোরগোড়ায়। লজের মালিক নারী খুব আন্তরিকভাবে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। তিনি বললেন, এখান থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই সাগরতীরে যাওয়া যাবে। আমার আর তর সইছিলো না, কিন্তু খিদেয় যে পেট চোঁ চোঁ করছে। অগত্যা শহরের মধ্যে গিয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর এগোলাম রাস্তার নির্দেশ অনুসরণ করে। সত্যি কিছুদূর হাঁটতেই সামনে দেখা গেলো সমুদ্র, ঝলমলে নীল চাদরের মতো বিছিয়ে আছে।
রাস্তার সমতল থেকে অনেকটা নিচে সৈকত। আসলে নিউকে শহরটা পাহাড়ি অঞ্চল, অসমতল ভূমি হওয়ায় কোথাও কোথাও সাগর সমতল থেকে অনেকটা নিচে। খাঁড়া পাহাড়ের দেয়ালের একপাশে বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নামলে তবে সাগরতীরের বালিতে পা পড়ে। গ্রীষ্মকালীন স্কুল ছুটির সময় হওয়ায় সেখানে প্রচুর পর্যটক। একপাশে সারি সারি খাবারের রেস্তোরাঁ।
নিউকে সার্ফিংয়ের জন্য বিখ্যাত। এখানকার উত্তাল সমুদ্র সারফারদের জন্য স্বর্গ, অনেকে সার্ফিং করছে। বিকেলের রোদে চারপাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, এখানে সাগর সৈকতে ছোট বড় পাহাড়ের টিলা দাঁড়িয়ে আছে, একপাশে খাঁড়া পাহাড় তো আছেই। খোলা সৈকতে এই গ্রানাইট পাথরের টিলাগুলো একটা অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এগুলোর জন্য সৈকতে রোদ-ছায়ার রহস্যময় খেলা।
সমুদ্রের জলে পা ফেলে হাঁটতে লাগলাম। লম্বা সমুদ্রের একপাশ থেকে অন্য পাশে যেতে সময় লাগে, হঠাৎ একটা পাথরের টিলা পেরিয়ে সামনে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম একপাশের একটা পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা! খুব গভীর নয় যদিও। গুহার ভেতরের প্রশস্ত জায়গায় রোদের আলো পড়েছে। একটু ভেতরের দিকে গুহার দেয়াল মাঝখানে নেমে এসে দু’পাশে দু’টি ঘরের মতো সৃষ্টি করেছে, ছোট-বড় পাথর ছড়ানো সেখানে। বিস্ময়কর পরিবেশ!
সমুদ্র সৈকতে এমন পাহাড়ের গুহা দেখতে পাবো তা কল্পনাও করিনি । কতকাল আগে এই সৈকত, গুহা তৈরি হয়েছে কে জানে? কখনো মানবপ্রজাতির কোনো পূর্বপুরুষ এই গুহায় বাস করেছে কিনা তাই বা কে বলতে পারে। কিছুদূর এগোতে আরেকটা পাহাড়ের গায়ে দেখি আরেকটা গুহা, এটির ভেতরে ঘন অন্ধকার, মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দেখতে বোঝা গেল গুহাটি ভেতরের দিকে বাঁক নিয়ে বেশ অনেকদূর চলে গেছে।
সৈকতের একপাশে গ্রানাইটের দেয়াল, তার ওপরে শহর, আরেকপাশে খোলা সমুদ্র, ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালিতে।
সাগর জলে পা ভিজিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লম্বা সৈকতে অন্য প্রান্তে কখন চলে এসেছি খেয়ালই করিনি, এত মশগুল হয়ে ছিলাম প্রকৃতিতে। তখন বেলা পড়ন্ত, সৈকতের একপাশে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের রাস্তা পর্যন্ত। সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর উঠে একটা কফিশপে বসলাম। দেখতে পেলাম সমুদ্রে জোয়ার আসছে, একটু একটু করে জল বাড়ছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম সৈকতের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যে বালির রাস্তা ছিল, সেখানে এখন জল থই থই। জল বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের গোঁড়া পর্যন্ত চলে এসেছে আর যে সৈকতটাকে এতক্ষণ লম্বা একটানা একটা সৈকত বলে মনে হচ্ছিল সেখানে এখন তিনটা আলাদা সৈকত! আগুপিছু হয়ে থাকা পাহাড়ের দেয়ালগুলোতে সাগরের জল ছুঁয়ে যাওয়ায় ভেতরে বালির জায়গাগুলো স্বতন্ত্র হয়ে তিনটি আলাদা সৈকতের সৃষ্টি হয়েছে, কাল সকালে যখন জল নেমে যাবে তখন আবার তিনটা সৈকত জোড়া লেগে একটা হয়ে যাবে। কি অদ্ভুত!
এখানে গ্রীষ্মকালে অনেক দেরিতে সূর্য ডোবে, তাই আকাশে আলো থাকে অনেকক্ষণ। পড়ন্ত রোদে ঝিমিয়ে থাকা সমুদ্রকে দেখছিলাম, যেন সে ঘুমের ঘোরে ঢুলছে, ঢেউগুলো তাই ছন্দবদ্ধ হয়ে তীরের বালিতে আছড়ে পরছে। পাহাড়ের ওপরের শহরে উঠে এলাম, রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসে অপলক চেয়ে রইলাম সমুদ্রের দিকে, আলোর সঙ্গে সঙ্গে রং বদলাচ্ছে তখন সে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২০
এএ