দিন ১
পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও= ৩৯.৪৭ কি. মি.
কুয়াশা ফিকে হয়ে আসার আগেই সকালবেলা রকি ভাইয়ের নানি শাশুড়ি আর শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম। রাতেই বলে রেখেছিলাম আমি খুব ভোরে বেরুবো, তাই সকালের নাশতার আয়োজনের কষ্টটা যেন করা না হয়।
এন্ডোমন্ডো অ্যাপটা চালু করে গুঁটি গুঁটি পায়ে হাঁটা শুরু করলাম চৌরঙ্গীমোড়ের উদ্দেশ্যে। 'পঞ্চগড় ০ কি.মি.’ লেখা মাইলফলকটা ওখানেই। আগের রাতেই ওদিকটা হেঁটে এসেছি। ডিস্টিলারি মোড় থেকে এগিয়ে ধাক্কামারার চত্বরে পৌঁছাতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। ধাক্কামারার মোড়ের ট্রাফিক বক্সটাকে মনে হচ্ছিল একটা দ্বীপ। সবুজ ঘাসের মাঝে যেন মাথা উঁচু করে রেখেছে। করতোয়া নদীর উপর নির্মিত সেতু পেরিয়ে চৌরঙ্গীতে গিয়ে এমন কাউকে খুঁজছিলাম যিনি আমাকে একটি ছবি তুলে দিতে পারেন। একজন ভ্যানওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে একটা ছবি তুলে দিতেই পা চালালাম।
মহাসড়ক এন-৫ ধরেই যাত্রা। গন্তব্য ঠাকুরগাঁও। আজ পাড়ি দিতে হবে ৪০ কি.মি. পথ। সকালের আরামদায়ক আবহাওয়ায় যদ্দুর পারি এগিয়ে থাকবো, এই পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই যাত্রা। দু'পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। চোখ বোলাতে বোলাতে যাচ্ছি এমন সময় ডাক এল-‘এক্সকিউজ মি’। ফিরে তাকাতেই রাস্তার অপর পাশ থেকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো এক তরুণকে। আমার সঙ্গে কথা বলে এককাপ চায়ের আমন্ত্রণ দিলেন। বাজারটা একটু পেছনের দিকে বলে আমি ইতস্তত করলেও ভদ্রলোকের আন্তরিকতায় সাড়া না দিয়ে পারা গেলো না।
মিলগেট পেরুতেই বিশাল সব গাছ চোখে পড়ছিল। এরচেয়েও নজরকাড়া ব্যাপার হলো অতিকায় গাছগুলো ঘিরে প্রচুর পরিমাণে ফার্নের উপস্থিতি। খানিকটা এগিয়েই পঞ্চগড় সুগার মিলের বিশাল টিনের নির্মিত কারখানা দৃষ্টিসীমায় এলো। এই মিলগুলোর একটা মজার ব্যাপার হলো, এগুলো সারাবছর খোলা থাকে না। আখ কাটার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালু থাকে এ কারখানাগুলো। রাস্তার এক পাশে মূল কারখানা আর অপর পাশে কোয়ার্টার, রেস্ট হাউজ, মসজিদ ইত্যাদি। সুগার মিল চোখে পড়লেও সুগার মিলের মূল কাঁচামাল তথা ইক্ষু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
এবার রাস্তার দু'পাশে সঙ্গ দিচ্ছে রেইনট্রি, মেহগনি আর শিশু গাছ। জুট মিল বাজার পেরিয়ে ময়দান দীঘির কাছটায় আসতেই জাঁকিয়ে বৃষ্টি এলো। আশপাশে দোকান-পাট না থাকাতে এই যুবক বয়সে শিশু গাছই ভরসা। বৃষ্টি একটু কমতেই ময়দানদীঘির পাড়ে উঠে চারপাশে চক্কর লাগালাম। কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়লো হিমালয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। আমার পর্বতপ্রেমী চোখ খুঁজে পাচ্ছে এমন সব নামই। সকালেই এক জায়গায় মাউন্টএভারেস্ট কলেজের ব্যানার পড়েছিল চোখে। এবারে টানা হেঁটে বোদা এসেফটোগ্রাফার ফিরোজ সাবাহ ভাইকে ফোন দিতেই আরেক দফা চা-মিষ্টি হয়ে গেলো। পথে নামতেই এবার তেড়ে বৃষ্টি। অল্প হাঁটতেই পঞ্চগড় জেলার সীমানা শেষ হয়ে গেলো। প্রবেশ করলাম ঠাকুরগাঁও জেলায়। কিছু জায়গায় শিশু গাছগুলো বড় হয়ে মাথার উপর চাঁদোয়া তৈরি করেছে। অপর পাশ থেকে সাইকেলে আসা এক বালক আমাকে দেখে একটু সুরে সুরে 'পাগল..... ' বলাতে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই বালক তার লাইনটি শেষ করল 'পাগল.... মন মনরে' বলে! মুচকি হাসি বিনিময় করে বালক সাইকেলে দূরে মিলিয়ে গেলো।
যাত্রাপথের দু'জায়গার চা বিরতি লোকজনের কৌতূহল নিবৃত্ত করতেই কেটে গেলো। পথে হাসপাতাল পেলাম দু-তিনটা। এনজিও পরিচালিত এসব হাসপাতাল খুব পরিপাটি।
মুন্সিরহাট পেরিয়ে ভুল্লি বাজার নামে এক বড়সড় বাজারের দেখা পেলাম। ভুল্লি নদীর উপর নির্মিত সেতুর দু’পাশেই বাজার। বৃষ্টিতে জুতা ভিজে যাওয়ায় খানিকটা বেকায়দায় পড়লেও টান হেঁটে সালন্দার কাছে গিয়ে পড়লাম বিশাল এক জমায়েতের মুখে। সম্ভবত কোনো সম্ভ্রান্ত মানুষের জানাজা। একটু পরেই ফোন দিলেন রুবাইয়া আপুর মা। আজ ওনাদের বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা। উনি কীভাবে আসতে হবে জানিয়ে দিলেন। পা চালিয়ে গন্তব্যের কাছে আসতেই আন্টিকে ফোন দিয়ে জানলাম পথের দিশা।
আংকেল আমাকে এগিয়ে নিতে এসেছিলেন। ওনার পিছু পিছু শহরের পূর্ব গোয়ালপাড়ায় তাদের সাজানো-গোছানো বাড়িটাতে ঢুকছি তখন বিকেল চারটে প্রায়। ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে শহর দেখতে বেরুলাম আংকেলের সঙ্গে। আংকেল বারবার জিজ্ঞেস করছিল- 'তোমাকে নিয়ে গেলে হেঁটে যেতে হবে? নাকি গাড়ি নিতে পারবো?' আমি হেসে জবাব দিলাম- 'এখন তো গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। গাড়ি নিতে আপত্তি নেই। ' শহরের এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আংকেল ডিসি অফিস, বড় মাঠ, জেলা স্কুল, মির্জা ফখরুলের বাড়ি দেখালেন। এর মধ্যেই ঠাকুরগাঁওয়ে কর্মরত মেজর ডা. সুমন খীসা দাদাকে ফোন করলাম। উনি বর্তমানে ডেপুটশনে বিজিবি হাসপাতালে কর্মরত। দেখা হতেই পুরো হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখালেন আর করলেন আপ্যায়নের চূড়ান্ত। আরো বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে সুমন'দা তার গাড়িতে আমার আজকের বাসস্থানের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন।
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ১০২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২০
এএ