দিন ২
ঠাকুরগাঁও–দশমাইল (দিনাজপুর)= ৪৬.৫০ কি. মি.
সেই ছয় সকালে (সকাল ছয়টা বাজে আর কি!) ঘুম ভাঙলো রান্নাঘরে রুবাইয়া আপুর মায়ের টুংটাংয়ে। সকালে না খেয়ে বের হওয়া আর কপালে রইলো না।
এবার রাস্তার দু'পাশে সঙ্গ দিল বিশাল সব সেগুনগাছ। সেদিকে তাকাতে তাকাতেই কানে এলো- 'ভাবি সালাম'। তাকিয়ে দেখি ক্লাসফোর-ফাইভ পড়ুয়া এক ছেলে তারই সমবয়সী স্কুল ড্রেস পরিহিত এক মেয়েকে এই নামে সম্বোধন করছে! কৌতূহল নিয়ে ক্যামেরার ছুতোয় একটু দাঁডিয়ে কথা-বার্তা শুনে বুঝলাম বন্ধুর প্রেমিকাকেই ভাবি বলে সম্বোধন করছে। ছোট খোচাবাড়ী, বড়খোচাবাড়ী পেরোতেই চোখে পড়ছিল সাইকেলে স্কুলগামী পিচ্চি-পাচ্চাদের। এদিকের লোকাল বাসগুলোর ছাদে লাল-সাদা-সবুজ পতাকা। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো লোকালরা বাসের ছাদে পতাকা দেখে কোনটা কোন রুটের বাস সেটা চেনে। বড়খোচাবাড়ী থেকে ২৯ মাইল পর্যন্ত পুরোটাই শিশু গাছের ছাওয়া। রোদ্দুর উঠে গেলেও হাঁটতে তাই খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছিল না। পাশেই বয়ে চলছিল ক্ষীণধারার এক খাল। এদিকে সব বাড়ির সামনেই পাকা চাতাল। কুঁড়েঘর হোক কিংবা পাকাবাড়ি, বাড়ির সামনে ধান শুকানোর সুবিধার্থে পাকা চাতাল আছেই। আর চোখে পড়ছিল বিশাল সব ফুলকপির ক্ষেত। আমার প্রিয় সবজিটিকে দু'চোখে প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছিলাম। ঠাকুরগাঁও জেলার সীমানা পেরুতেই এদিকের বেশির ভাগবাজারের নাম বদলে গেছে মাইলে। কোনোটা ২৯ মাইল বাজার, কোনোটা ২৬ মাইল বাজার। ২৮ মাইল বাজারের পরে একটা সেতু পার হওয়ার সময় চোখ আটকে গেলো সেতুর তলায়। মানুষ, গরু-ছাগল, হাঁস সবাই হাঁটু সমান পানিতে গোসল করছে। বটতলা বাজার থেকে একটু এগোলেই সিংড়া জাতীয় উদ্যান যাওয়ার রাস্তা। আমি অবশ্য তেমন একটা আগ্রহ দেখালাম না। দেশের জাতীয় উদ্যানগুলোর অবস্থা তথৈবচ।
একগাদা বাচ্চাকে স্কুলের শিক্ষক রাস্তা পার করে দিচ্ছেন, এই দৃশ্য চোখে পড়লো ভোগনগরের কাছে। পথিমধ্যে এক লোক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো- 'আপনি কি কোনো কোম্পানি থেকে আসছেন ভাই?' তেমন কোনো কোম্পানির খোঁজ এই দেশে এসব বনের মোষ তাড়ানো কাজে কেউ পেলেই তো! চাকাইয়ের টালিথা কুমী চার্চ থেকে এগিয়েই বীরগঞ্জ বাজার। উপজেলা সদর হলেও জেলা সদরের মতোই ব্যস্ততা চারপাশে।
রুবাইয়া আপুর বাবা আগেই বলে রেখেছিলেন বীরগঞ্জে সাধনা সুইটসের মিষ্টি যেন মিস না করি। স্পঞ্জমিষ্টিটা খেতে ভালোই ছিল। এগিয়ে বীরগঞ্জ জাতীয় উদ্যানের গা ঘেঁষে চলা। সামাজিক বন বিভাগের অধীনে এই উদ্যানটি। রাস্তা থেকে বেশ ক'টা পায়ে হাঁটার ট্রেইল ঢুকেছে ভেতরের দিকে। আজ সকালে ৪-৫ কি.মি. চলার পর থেকে বাঁ পায়ে কেমন জানি ভোঁতা একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল। সেটা গতি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। জাতীয় উদ্যান পার হতেই প্রবেশ করলাম কাহারোল উপজেলায়। এর মধ্যেই ফোনে কিছুক্ষণ পরপরই আমার খোঁজ নিচ্ছিলেন দিনাজপুরের মুইজ মাসুম ভাই। ওনার বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা আজ। রামপুর থেকে হাতের ডানের রাস্তা দিয়ে এবার মুকুন্দপুর। উদ্দেশ্য কান্তজিউ মন্দির যাওয়া। আগেও বার দুয়েক এসেছি। পথে যখন পড়েছেই, আরেকবার ঢুঁ মেরে এলাম। এখানে এসেই এক বিপত্তি। এক ছেলে এসে জিজ্ঞেস করলো- 'আপনাকে বীরগঞ্জে হাঁটতে দেখেছি। কী করেন আপনি?'
এবার পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত শুনে আমাকে আজকের গন্তব্যের কথা শুধাতেই আমি উত্তর দিলাম- দশমাইল। কীভাবে যাবো প্রশ্নের জবাবে হেঁটে যাবো জানালাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললো -'আপনার মনে হয় টাকা-পয়সার সমস্যা। আমি দেব টাকা?' আমার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার পরেও ওই ছেলে থামে না। তার বাইকের পেছনে করে দশমাইল এগিয়ে দিতে চায়। অনেক কষ্টে তাকে নিরস্ত করে কান্তনগর মোড়ে পৌঁছাতেই চোখে পড়লো একটা ভাস্কর্য। তেভাগা আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে এর নতুন নামকরণ হয়েছে তেভাগাচত্বর।
বারো মাইল থেকে বাকি পথটুকু গাড়ির হেডলাইটের আলোয় হেঁটে দশমাইল পৌঁছাতেই দেখি মুইজ মাসুম ভাই তার বন্ধু-বান্ধবসমেত ফুল নিয়ে হাজির। আজকের হাঁটা এখানেই শেষ। এন্ডোমন্ডো জানান দিল হেঁটেছি প্রায় সাড়ে ৪৬ কি. মি.। এখান থেকে মুইজ ভাইয়ের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বাড়িতে গেলাম টমটমে। একে একে পরিচিত হলাম মামুন ভাই, মানিক ভাই আরশিপন ভাইয়ের সঙ্গে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প, দেশপ্রেম, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে দারুণ আড্ডা হলো। চঞ্চল ভাই আর রুকু ভাই আসতেই মৌ ভাবির রান্না করা সুস্বাদু খাবারটা দিয়ে সারা হলো রাতের খাবার।
আরও পড়ুন>>পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২০
এএ