গুরুজীর ওই কথা প্রাসঙ্গিকতা না হারালেও তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণ করে বাঙালি কিন্তু ঠিকই মানুষ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সাতকোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।
জাতির জনক ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্ন করে রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘কবিগুরুর কথা আ(ই)জ মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে, বাঙালি আ(ই)জ মানুষ হয়েছে’। বুঝিবা সেদিন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে খুশি কেউ হয়নি।
খুশি হতেন আজও। যদি জানতেন যে বাঙালি আজ অন্দরমহলের অন্তর্জাল ছিন্ন করে শুধু বাড়ির পাশে দুই পা নয়, লক্ষ্য ক্রশ দূরেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। বাঙালির বিচরণ আজ বিশ্বজুড়ে। কিন্তু বিশ্বজয়ী বাঙালি তার পড়শীর কথা ভুলে যায় নি, ভুলে যায়নি তার সংগ্রামমুখর দিনগুলোকে, তার জন্মযুদ্ধকে।
বঙ্গবন্ধুও তাই স্বদেশ প্রত্যাবর্নের সময় ভুলে যাননি ভারতের কথা। দিল্লি হয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে তবেই তিনি ঘরে ফিরেছিলেন। জন্মযুদ্ধের সে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে ঢাকা-দিল্লি আজো আবদ্ধ।
কিন্তু ইতিহাস বলে, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক হচ্ছে কূটনৈতিক, ঢাকা-কলকাতা সম্পর্ক হচ্ছে সামাজিক-পারিবারিক আর ঢাকা-আগরতলা সম্পর্ক হচ্ছে আত্মিক। আত্মিক সে যোগাযোগের সূচনা কবে কোনখানে তা বলা মুশকিল। সুবে-বাংলা বা ব্রিটিশ বাংলার সময়ও ঢাকা আগরতলা ইতিহাসের একই গতিপথে প্রবাহমান ছিল। তারপর র্যাটক্লিফের মানচিত্র নির্মাণ (নাকি কর্তন) ও মধ্যরাতের স্বাধীনতা (Freedom at Midnight)! অতঃপর কী পেলাম, কী হারালাম সেই হিসেব।
কেটে গেলো আরো দুই যুগ। শুরু হলো নতুন করে জন্মযুদ্ধ। সে যুদ্ধে পাশে এসে দাঁড়ালো আবার সে কূটনৈতিক, সামাজিক ও সেই আত্মার বন্ধুরা, যার যা আছে তাই নিয়ে। দিল্লি এগিয়ে আসলো তার কূটনীতি নিয়ে, কলকাতা তার মানবিক সাহায্য ও আশ্রয় নিয়ে আর আগরতলা তার মাটি ও মানুষ নিয়ে। আগরতলার মাটি বাংলার স্বাধীনতার ঘাটি। এখানকার মানুষ আমাদের স্বাধীনতার প্রেরণা।
ত্রিপুরা আমাদের সীমান্তবতী রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী আগরতলা ’আগরতলা’ শব্দটি আমাদের কাছে পরিচিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র নাম থেকে। তথাকথিত এ ’ষড়যন্ত্র মামলায়’ পাকিস্তান গোয়েন্দাবাহিনী প্রায় দেড় হাজার বাঙালিকে এ মামলায় গ্রেফতার করে, আর ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে।
এ মামলার এক নম্বর আসামি করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার কারণেই আইয়ুব খানকে গদি ছাড়তে হয়েছিল। ইতিহাস বলে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে আগরতলা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের অলিখিত রাজধানী। কেবল চৌদ্দ লক্ষ শরণার্থীই নয়, রাজনৈতিক আশ্রয় ও সশস্ত্র প্রতিরোধ নেতৃত্বের বড় অংশের আশ্রয়স্থল ছিল আগরতলা।
যাদের ভালোবাসা ও সমর্থনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পেয়েছিল নির্ভরতার ভূমি ও যুদ্ধের প্রেরণা-তারা আর কেউ নয়, এই ত্রিপুরাবাসী। এখানে আশ্রিত শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য তখন ইন্দিরা গান্ধী কয়েকবরা এসেছিলেন এই ত্রিপুরায়। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট এক ভাষণে তিনি বলেছিলনে, ’পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা যারা এখানে এসেছে তারা এখানে নিমন্ত্রণ খেতে আসেনি।
তার আক্রান্ত, বিপন্ন। ...ভারত তার মানবিক দায়িত্ব ও দায় থেকে চ্যুত হতে পারে না বা কারো ভয়ে ভীত হয়ে সে দায়িত্ব থেকে বিরত হবে না’। এভাবে অসংখ্য আশ্রয়কেন্দ্রে সেদিন আশ্রয় নিয়েছিল আমাদেরই পূর্ব পুরুষরা। বিশ্বের বুকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার শেষ লড়াইটা আমরা শিখেছিলাম এই আগরতলা থেকেই। একাত্তরে সীমান্ত জুড়ে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো সে কথাই জানান দেয়।
কিন্তু সেতো ইতিহাস। হ্যাঁ, ইতিহাসের পথ ধরেইতো আগামীর পথ চলা। আর সম্পর্কটা যেখানে আত্মার, সেখানে সে পথতো মধুর হবেই, ভ্রমণ সেখানে হবে আরো মধুময়। আগেই বলেছি, বাঙালি আজ ঘর ছেড়ে বেড়িয়েছে। সদর দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে সে পড়শির উঠোনে উঁকি দিতে শিখেছে।
পড়শির উঠোনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য অজানা-অদেখা রূপ-বৈচিত্রের আধার। সেখানে আছে ছোট-বড় কত না রাজবাড়ি, মসজিদ, মন্দির, প্রসন্ন বাগান, বিহার, নির্মল পানির হ্রদসহ আরো কত কি!
সে খতিয়ান আরো দীর্ঘ-চতুরদাস দেবতার বাড়ি, মহারাজা বীর বিক্রম কলেজ, উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ, ভ্রহ্মকুণ্ড, জগন্নাথ মন্দির, বেনুবন বিহার, বনবীথি, বড়মুড়া ইকো পার্ক, সিপাহীজলা অভয়ারণ্য, কমলাসাগর, নীরমহল প্রাসাদ, ত্রিপুরাশ্বীর মন্দির, ভুবনেশ্বরী মন্দির, টিপাই ইকো পার্ক, ছবিমুরা, পিলাক, তৃষা অভয়ারণ্য, মহামুনি প্যাগোডা, কালাপানিয়া পার্ক, উনাকোটি, জাম্পুই পাহাড়, গেদু মিয়া কলেজ, ডামবুর লেক, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, দুর্গাবাড়ি, উমা মহেশ্বর মন্দির, দুর্গা বাড়ি বাগানসহ আরো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এছাড়া এখানকার সবুজ বনানী, আকাবাকা সড়ক ও পাহাড়ের সবুজ চাহনি আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
ঢাকা থেকে আগরতলা মাত্র তিনঘণ্টার যাত্রা। সকালের ট্রেনে উঠলে নয়টার মধ্যেই আখাউড়া বর্ডার ইমিগ্রেশন। সীমান্ত পার হয়ে ২০ মিনিটেই পৌঁছে যাবেন আগরতলা।
থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হবে না। অনেক ভালো ভালো হোটেল আছে।
তারপরও হাতে সময় না থাকলে দিনে এসে দিনেই ঘুরে যেতে পারেনর্ পয়সা খরচ করে আমরা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর এমনকি কলকাতা যাওয়ার ফুসরত খুঁজি। অথচ এতো কাছের পযর্টন স্পট আমাদের আকর্ষণ করেনা।
উইন্টার ভ্যাকেশন কাটাতে পাড়ি জমাই দূর-বহুদুর, অথচ পড়শির বাড়ির উঠোনো রোদ্দুরের খোঁজ রাখি না। তাই চোখ রাখতে চাই এবার ত্রিপুরার চোখে। বাংলানিউজের চোখে দেখুন ত্রিপুরা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫১ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৭
ইএপি/