মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী নামেই পরিচিত ছিলেন ক্যাপ্টেন রঞ্জন। ১৯৭১ সালে ত্রিপুরায় স্থাপিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি আগরতলায় বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তার ছেলে রাজীব চ্যাটার্জী এসব কথা জানান। তুলে ধরেন তার বাবার যুদ্ধদিনের সেইসব স্মৃতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের গল্প।
রাজীব বলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এতে আমার বাবারও অবদান রয়েছে। যা নিয়ে আমরা বুক ফুলিয়ে গর্ববোধ করি।
‘আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিষয়ই জানতেন। তবে তিনি কিছুই বলতে চাইতেন না। কেন চাইতেন না। তা আমরাও জানি না। তিনি ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি না ফেরার দেশে চলে যান। আমরা মনে করি, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা গল্প ও ঘটনার সমাপ্তি হয়েছে। ’
জানা যায়, ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জীর জন্ম ১৯৩৪ সালে ২ ফেব্রুয়ারি, ত্রিপুরার বর্তমান উত্তর জেলার ধর্মনগর শহরে। স্থানীয় কলেজে আইএ পাস করার পর তিনি যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। এরপর তাকে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে (আইএমএ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্টিলারি রেজিমেন্টে। ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জীর ছেলে রাজীব চ্যাটার্জী বাংলানিউজকে বলেন, একদিন বাড়ি ফিরে ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শচীন্দ্রলাল সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন আমার বাবা। এ সময় তিনি বাবাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। বাবাও রাজি হয়ে যান।
‘পরে এ কথা শচীন্দ্রলাল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করেন। ইন্দিরা গান্ধী বাবাকে ডেকে পাঠান এবং বেশ কিছু নির্দেশনা দেন। কিন্তু বাবা তা আমাদের কাউকে বলেননি। দিল্লি থেকে ফিরে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। ’
আলাপচারিতায় রাজীব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- স্বেচ্ছায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া তরুণদের বন্দুক চালানোসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ করার সাহস ও সমর্থ্যবান করে তোলা।
ত্রিপুরার বর্তমান সিপাহীজলা জেলার চরিলাম এলাকায় স্থাপিত গঙ্গা-যমুনা ক্যাম্পের মূল দায়িত্ব পান ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী। মূলত তার নেতৃত্বেই সেখানে প্রশিক্ষণ নিতেন বাংলাদেশের যুবকেরা।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে চলাকালে রাতের আঁধারে সুযোগ বুঝে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায়। যেখানে হানাদারদের বিরুদ্ধে কৌশল অনুযায়ী ঝাঁপিয়ে পড়তেন যোদ্ধারা।
‘সম্মুখ যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতেন। তাদের সঙ্গে অনেক সাধারণ মানুষও আসতেন, যারা যুদ্ধে আহত হয়েছেন। শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী বণ্টনের গুরু দায়িত্বে ছিলেন আমার বাবা। তার সঙ্গে ছিলেন দিল্লি থেকে আসা ক্যাপ্টেন শর্মা।
১৯৭১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া রাজীব বলেন, মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাবাকে দেখতে আমিও ক্যাম্পে যেতাম। ট্রেনিংসহ অন্যান্য কাজের চাপের কারণে আমাদেরও সময় দিতে পারতেন না তিনি।
প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্মৃতির কথা উল্লেখ করে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জীর ছেলে বলেন, প্রশিক্ষণের আগে সকাল-সন্ধ্যায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতেন প্রশিক্ষণার্থীরা।
গঙ্গা এবং যমুনা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশাপাশি ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী ও ক্যাপ্টেন শর্মা পার্শ্বর্বর্তী বিশালগড় এলাকার পদ্মা ও মেঘনা ক্যাম্পের দায়িত্বেও ছিলেন।
রাজীব চ্যাটার্জী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সেনাবাহিনীর তিনজন কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানান। এর মধ্যে আমার বাবাও ছিলেন। অন্য দু’জনের সঙ্গে ওই সময় তিনিও বাংলাদেশে গিয়েছিলেন।
‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত অনেক দলিল আমাদের বাড়িতে ছিল। কিন্তু এগুলোর গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারিনি। যার জন্য অনেক কিছুই এখন নষ্ট হয়ে গেছে,’ যোগ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী কোনো আলোচনায় না থাকায় কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের। রাজীব চ্যাটার্জী বলেন, আমার বাবার অনেক অবদান। কিন্তু তা সেভাবে আলোচনায় আসেনি। তবে আমার বাবা সাধারণ জীবনযাপন করেছেন।
আগরতলা থেকে চরিলাম এলাকার তৎকালীন গঙ্গা-যমুনা ক্যাম্পের পাশে একটি কুঁড়েঘরে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। যদিও তার পরিবার আগরতলা শহরে চলে এসেছিল।
তারপরও তিনি দীর্ঘবছর ওই কুঁড়েঘরে একাই থাকতেন বলে জানান রাজীব চ্যাটার্জী।
বাংলাদেশ সময়: ০৪২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৯
এসসিএন/আরআইএস/এমএ