সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে: কামাই-রোজগার করতে প্রতিনিয়ত যেমন সংগ্রাম করতে হয়, তেমনি বাজার সদাইয়ের জন্যও তাদের সংগ্রামে নামতে হয়। তবুও মিলে না ভালো মানের পণ্য কিংবা জিনিসপত্র।
যা পাওয়া যায়, সেগুলো কিনতে মূল ভূ-খণ্ডের চেয়ে গুনতে হয় অনেক বেশি মূল্য। পণ্যের মোড়কে খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকলেও সে অনুযায়ী বিক্রি করেন না দোকানিরা।
দোকানিদের এক কথা, এখানে পণ্য আনা নেওয়া করতে অনেক খরচ পড়ে যায়। সে কারণে মোড়কের গায়ে লেখা দামে বিক্রি করা সম্ভব হয় না।
তারা বলছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে সব পণ্যই আনা হয় টেকনাফ থেকে। প্রথমে ট্রাক-পিকআপে করে দমদমিয়া ঘাটে। তারপর ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন ঘাটে আনতে হয়। সেখান থেকে ভ্যানে করে দোকানে।
এভাবেই প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যসহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করতে হচ্ছে দেশের পিছিয়ে থাকা জনপদ সেন্টমার্টিনের বাসিন্দাদের।
মো. সামছুল নামের এক দোকানি জানান, টেকনাফ থেকে একটি বস্তা সেন্টমার্টিন আনার বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়।
‘এরমধ্যে দুই পাড়ে ঘাটের জমা ৩০ টাকা, ট্রলার ভাড়া ৩০ টাকা, টেকনাফে তোলা ও সেন্টমার্টিনে নামার খরচ দিতে হয় ২০ টাকা। সব মিলিয়ে একটি বস্তা আনতে খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। তাও শীতকালে। বর্ষা মৌসুমে অনেক ট্রলারেই আসতে চায় না। ’
তিনি বলেন, বর্ষাকালে এখানে মালামাল আনতে হলে বাড়তি খরচ দিতে হয়। তাহলে নির্ধারিত মূল্যে কীভাবে পণ্য বিক্রি করবো?
একটু এগিয়ে কাঁচা বাজারে গিয়ে আরও হতাশ হতে হলো। একটি দোকানে বেগুন বিক্রি ৬০ টাকা কেজিতে। কিন্তু এসব বেগুন শুকিয়ে একেবারেই প্লাস্টিকের মতো হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঢেড়স, মরিচ, টমেটো ছাড়া অন্য সবজি উৎপাদিত হয় না। এর বাইরে তরমুজ চাষ হয়।
বাকি সব কিছুই আসে টেকনাফ থেকে। এতে সময় লেগে যায় বেশ। তাই টাটকা সবজি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। মায়ানমারের নিম্নমানের পণ্যও পাওয়া যায় বাজারে।
বুধবার (০৬ এপ্রিল) বিকেলে মোহনীয় সৈকতে ঘুরার সময় চোখ আটকে গেলো একটি ট্রলারে। সাগরে এক বুক পানি, কখনও গলা পানি ডিঙ্গিয়ে ট্রলার থেকে মালামাল নামাচ্ছিলেন কয়েকজন শ্রমিক।
তাদের গায়েও বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো তখন। বিশাল জলরাশির ঢেউ উপেক্ষা করেই ট্রলার থেকে পণ্য ডাঙ্গায় তুলছেন তারা।
ট্রলার থেকে মালামাল নামনোর জন্য না আছে জেটি, না আছে অন্য কোনো ব্যবস্থা। তাই বালুকাময় তীরের কিছু দূরে ভিড়ানো ট্রলার থেকে গলা পানিতে গিয়ে মালামাল আনলোড করতে হয় শ্রমিকদের।
এমনই একটি পণ্য বোঝাই ট্রলার থেকে ময়দা ও চিনির বস্তা নামাচ্ছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। গলা পানি ভেদ করে একজন মাথায় করে তীরের কাছাকাছি এনে দিচ্ছেন (একতৃতীয়াংশ) আরেকজনকে।
সেখান থেকে আরেকজন মাথায় করে আরও দুই-তৃতীয়াংশ ও তৃতীয়জনের মাথায় ঘুরে ঠেলায় গিয়ে পড়ছিলো বস্তাগুলো।
বস্তার পাশাপাশি একজন কিছু কাঠ নামালেন ট্রলার থেকে। উদ্দেশ্য সেন্টমার্টিন বাজারে লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করা। টেকনাফের স’মিল থেকে সংগ্রহ করে এগুলো আনা হয়েছে।
ট্রলার থেকে পণ্য নামানো শেষ, এবার সৈকতের বালি মাড়িয়ে দোকানে নিয়ে যাওয়ার পালা। ঠেলার দুই দিকে ঠেলছেন ১০ শ্রমিক। তবে বালুতে আটকে যাওয়া ময়দা ও চিনি বোঝাই ঠেলাটি যেনো নড়তেই চায় না।
এবার ঠেলার চাকা ধরে ‘আলীরে আলী’ বলে স্লোগান ধরলেন শ্রমিক মাহফুজার।
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্যরা বললেন, হেইও, আরও জোরে, হেইও, সবাই মিলে, হেইও...’। এভাবে ছন্দের তালে আর শ্রমিকদের সর্বশক্তি সঞ্চয় করে ঠেলায় কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছে ঠেলাটি।
ছন্দের বেশির ভাগই স্থানীয় ভাষায় এবং লেখার অনুপযুক্ত। এসবের অর্থ কী জানতে চাইলে এক গাল হেসে শ্রমিকদের একজন বললেন, ‘মজা করি। আমাদের তো আর কোনো আনন্দ করার সুযোগ নেই। তাই কাজের মধ্যেই একটু মজা করি। তাতে বিশাল বোঝা টানার কষ্ট মনেই থাকে না। ’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে পানি পথের দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে নৌযান।
তিন দিক দিয়ে ভিত শিলায় বেষ্টিত দ্বীপটিতে প্রায় ৯ হাজার লোকের বসবাস রয়েছে। প্রতিদিনেই অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে।
নানা সমস্যা নিত্যসঙ্গী হলেও শুষ্ক মৌসুমে কোনোভাবে কেটে যায় অধিবাসীদের। তবে বর্ষা মৌসুমে তাদের পড়তে হয় চরম সঙ্কটে। কারণ তখন নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে, চলে না জাহাজও।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৬
এসআই/এমএ
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** ১৮ কোটি টাকার মেরিন পার্ক ১০ বছরেই ‘মৃত’