কক্সবাজার থেকে: প্রবাদে আছে, মরার ওপর খাড়ার ঘা.. অর্থাৎ দুর্বলের ওপর সবলের আঘাত বা চাপ। লবণচাষিদের ওপর প্রকৃতির আচরণ অনেকটা তেমনই।
এজন্যই বলা হয়, মেঘ এলেই মাটি লবণ খেত।
শুক্রবার (০৮ এপ্রিল) কক্সবাজার জেলা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ইসলামপুর ইউনিয়নের লবণশিল্প এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও সম্ভাবনার কথা।
চাষিরা জানান, লবণ চাষের জন্য দরকার কড়া রোদ্দুর। বৃষ্টি বা মেঘ হলেই লবণ চাষ মাটি হয়ে যায়। কারণ, একদিন বা এক মুহূর্তের জন্য বৃষ্টি হলেই সাতদিনের জন্য লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
লবণ উৎপাদনের প্রথমে সমতল ভূমিকে পৃথক পৃথক ভাগে প্লট তৈরি করে পলিথিন বিছানো হয়। তার আগে ভূমিটাকে শুকিয়ে নিতে হয়। কেননা, পলিথিনের নিচে ভেজা থাকলে লবণ চাষে বিঘ্ন ঘটে।
শুক্রবার লবণ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ইসলামপুরে যাওয়ার পথে বাসে কথা হয় কুতুবদিয়ার লবণচাষি মো. মিনহাজ উদ্দিনের সঙ্গে।
লবণচাষি মিনহাজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আকাশে মেঘ দেখলেই আমাদের মুখে কালো মেঘ জমে যায়। কেননা, বৃষ্টি হলেই পুরো সাতটা দিন মাটি, এক দানাও লবণ হবে না। বৃষ্টির পানি জমিতে পড়লে লবণাক্ত পানি মিঠা পানিতে পরিণত হয়ে যায়। ফলে কোনো লবণ হয় না। তাছাড়া আবার জমি শুকিয়ে লবণ উৎপাদনের উপযোগী করতে প্রায় সাতদিন লেগে যায়। এর মধ্যে যদি আবার বৃষ্টি হয়, তাহলে তো মহাবিপদ’।
মিনহাজ উদ্দিন কুতুবদিয়ায় ২০ কানি (এক কানি সমান ৪০ শতাংশ) জমিতে লবণের চাষ করেন। কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ এবং আলী আকবর ড্রেনের পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করা হয়।
এক কানি জমিতে লবণ চাষ করতে দু’জন শ্রমিকের দরকার হয়। লবণ খেতের মালিক সাত মাসের জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে লবণ চাষের চুক্তি করেন। প্রতি মাসে ৯ হাজার টাকা করে একজন শ্রমিককেই দিতে হয় ৬৩ হাজার টাকা। চুক্তি হওয়ার পর বৃষ্টির কারণে লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকলেও শ্রমিকের টাকা বন্ধ হয় না।
এছাড়া নদী বা সাগর থেকে ইঞ্জিন চালিত মেশিনের মাধ্যমে পানি আনতে প্রতি কানি জমিতে প্রায় ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। লবণ গাড়িতে ওঠাতে লেবার খরচ মণপ্রতি ২৫ টাকা। এভাবে বিভিন্ন খরচ দিয়ে এক কানি জমিতে লবণ উৎপাদনে প্রায় লাখ টাকা ব্যয় হয়ে যায়। এর মধ্যে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে লবণচাষির মাথায় হাত।
মিনহাজ উদ্দিনের মতোই একই কথা জানান ইসলামপুর লবণের মাঠের অন্য চাষিরা।
লবণচাষি সাবুদ্দিন বলেন, ‘আমরা আল্লার ওপর ভরসা করে বসে থাকি। বৃষ্টি না হলে আমাদের জন্য মঙ্গল। বৃষ্টি হলেই আমরা বিপদে পড়ে যাই। লবণ হয় না, আমরা তখন কি করবো? আমাদের একমাত্র কাজই লবণ চাষ। এই লবণ চাষের ওপর আমাদের পরিবার বেঁচে থাকে’।
ইসলামপুর এলাকার মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস লবণ চাষ। এখানকার লবণচাষিদের দাবি, লবণের ন্যায্যমূল্য থাকলে উৎপাদন কম হলেও পুষিয়ে যায়। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিরা লবণ উৎপাদনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
হাজী সল্ট রিফাইনারির মালিক জাবেদ আল মামুন জানান, এবার গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে লবণচাষিদের বিপদ ছাড়া উপায় নাই। এভাবে বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদন একদমই বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, লবণ চাষ টিকিয়ে রাখতে হলে বাইরে থেকে লবণ আমদানি পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। না হলে লবণচাষিরা তাদের পেশা থেকে সরে যাবেন।
বর্তমানে লবণ চাষের বেহালদশা বলেও জানান তিনি।
শুধু মামুনই নন, এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষই লবণচাষি। তাদেরও একই দশা। লবণচাষিদের সব সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
লবণ শিল্পের ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, পঞ্চদশ শতাব্দীতে কক্সবাজার জেলায় লবণের চাষ শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে লবণ ব্যবসা বিকাশ লাভ করলেও অষ্টদশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানি শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে উপকূলীয় জমি পরিস্কার করে সাগরের পানি সূর্যের তাপে বাষ্পিভূত করার মাধ্যমে লবণের চাষ শুরু করেন এক ব্যক্তি।
১৯৪৭ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলার গোমাতলী মৌজায় ১২০ একর জমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত নিয়ে লবণের চাষ শুরু করেছিলেন অন্য এক ব্যক্তি। সেই থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লবণ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) এর তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলায় ৬৩ হাজার ৫৩২ একর লবণের মাঠ এবং ৪৩ হাজার ৫০০ জন লবণচাষি রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৬
এসএম/এএসআর
** কি করে হয় লবণ চাষ
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন-সুন্দরবন ঘিরে নানা পরিকল্পনা
** প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ‘জেট স্কি’
** লাবনী-সুগন্ধা নয়, পুরো সৈকতে উপযোগী পরিবেশ দরকার
** বয়া ছাড়াই জাহাজ চলছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনে
** প্রবাল পাথরের ভাঁজে ভাঁজে মাছের খেলা
** পঁচা মাছে নষ্ট হচ্ছে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য
** দূর থেকে ভাসমান, কাছে গেলেই দৃশ্যমান ছেঁড়া দ্বীপ
** ছেঁড়া দ্বীপে যেতে অবশ্য করণীয়|
** পর্যটন নগরীতে বাংলা ভাষার বেহাল দশা