লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে (মৌলভীবাজার): দেশের প্রধান অর্থকারী ফসল ধান। কিন্তু লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে সিড-লেস লেবু (যার কোনো বিচি হয় না)।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের তিন ঘণ্টার ট্রেইলে প্রায় ৭ কিলোমিটার পথ হাঁটলেই পাওয়া যাবে এই লেবু বাগান। ট্রেইল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষের দেওয়া নাম।
গহীন বনের ভেতর দিয়ে ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর চোখে পড়ে লেবু বাগান। লেবু বাগানে ঢোকার আগেই লাউয়াছড়া বনের ভেতর দেখা মেলে বাগানের ম্যানেজার মো. ইউসুফের সঙ্গে। নির্জন বনের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ মোটরসাইকেলের শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। পরে তার পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, আপনারা আর একটু হাঁটলেই লেবু বাগান পাবেন; আমি ওই বাগানের ম্যানেজার।
তার কথা মতো লেবু বাগানে গিয়ে মেলে লেবু চাষের আদ্যোপান্ত। মো. ইউসূফ বলেন, আমরা এখানে ৩০ কেয়ার (আঞ্চলিক শব্দ কেয়ার মানে বিঘা) (৩৩ শতাংশে এক কেয়ার) জমিতে অর্থাৎ ১০ একর জায়গায় লেবু চাষ করি।
তিনি জানান, তার লেবু বাগানে প্রায় দুই হাজার গাছ রয়েছে। এসব গাছের কোনোটি থেকে ২০০ লেবু, কোনো গাছে ২৫০টি আবার কোনো গাছ থেকে ৭০ থেকে ৮০টি লেবু তোলা হয়। গড়ে প্রায় প্রতিদিনই গাছ থেকে লেবু তোলা হয়। প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ১৬০০ লেবু সংগ্রহ করা সম্ভব। ফলন ভালো হলে কখনও আবার ৩২০০ লেবু পাওয়া সম্ভব বাগান থেকে।
গাছ থেকে লেবু তুলে ছোট ঠেলাগাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীমঙ্গল বাজারে। এই ছোট ঠেলাগাড়িতে ৮০০ লেবু নেওয়া যায়। আর এই ৮০০ লেবুর দাম কখনও দুই হাজার আবার কখনও বা ১৫শ’ টাকায় বিক্রি করতে হয় জানান, ম্যানেজার মো. ইউসূফ। তার হিসেব মতে মাসে একটি বাগান থেকে ২৪ থেকে ৪৮ হাজার লেবু তোলা হয়। এ থেকে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি করলেও মাসে ৯৬ হাজার টাকার লেবু বিক্রি হয় জানান ম্যানেজার।
তার মতো আরও ১৪/১৫ জন মালিক লাউয়াছড়ায় লেবু চাষ করেন। লেবু চাষিরা একটি গাছ থেকে বছরে তিনবার ফল তুলতে পারেন। এই লেবু দিয়ে তাদের অর্থের চাকা ঘুরে।
তবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গা ঘেঁষে এভাবে লেবু চাষ মেনে নিতে পারেন না উদ্যান কর্তৃপক্ষ। এতে করে প্রাকৃতি, বনের সৌন্দর্য হারাচ্ছে বলে মনে করেন বন কর্মকর্তারা।
লাউয়াছড়া ফরেস্ট রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার মো. শাহেব আলী মিয়া বাংলানিউজকে জানান, লেবু চাষিরা বাগানের ভেতর দিয়ে চলাচল করায় বনের প্রাণীদের মারত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কারণ গাড়ির শব্দে বন্যপ্রাণিরা অবাধে চলতে পারছে না। আবার অনেক দুষ্টু লোক এসব লেবু চাষিদের সহযোগিতায় বাগানের গাছ কেটে নিয়ে যায়।
তবে তার এই অভিযোগ একেবারেই মানতে নারাজ লেবু চাষিরা। ম্যানেজার মো. ইউসূফ বলেন, আমরা মোটরসাইকেল নিয়ে আসি তাতেই ক্ষতি হয়। তাহলে বনের ভেতর দিয়ে কীভাবে ট্রেন চলে, মানুষ কীভাবে পিকনিক করে। এটি তারা দেখেন না?
তিনি বলেন, ফরেস্ট অফিসাররা বলেন- আমরা ক্ষতি করছি, কিন্তু বছরে ঠিকই তাদের ৪২ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে বোনাস দিতে হয়। তা না হলে বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে দেয় না।
তার এই ৩০ কেয়ার জমির লেবু বাগানে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাতজন লোক কাজ করেন। তাদের কেউ লেবু তোলেন, কেউ বা গাছের পরিচর্যা করেন। বাগানের ভেতরেই মাটির ছোট কুঁড়েঘরে ঘর করে বাস করেন বাগানের শ্রমিকরা।
প্রসঙ্গত, লাউয়াছড়া প্রকৃতিক বনকে ১৯৯৬ সালে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। এর আয়তন ১২৫০ হেক্টর।
**নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন মিহির কুমার দো
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
এসএম/আইএ