ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

অরূপরতনের সন্ধানে শ্রীচৈতন্যের বাস্তুলীলায়

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬
অরূপরতনের সন্ধানে শ্রীচৈতন্যের বাস্তুলীলায় ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিলেট থেকে:

‘তিন পাগলে হৈল মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
…………………………………..
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে

পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকির লালন ভয় তরাসে
চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে’।

এই তিন পাগলের চৈতে হলেন নিমাই- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। নিমগাছের নিচে জন্ম নেওয়ায় তার এই নাম।

ঢাকা থেকে সিলেট, এরপর সেখান থেকে সরাসরি ৩০ কিমি দূরে ঢাকা-দক্ষিণ বাজার। এখান থেকে এক-দেড় কিমি দূরত্বে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পিতামহের বাড়ি। জীবদ্দশায় ঠাকুমাকে দেখতে এখানে এসে কীর্তনলীলা সম্পাদন করেন মহাপ্রভু।

শ্রী চৈতন্য দেবের কীর্তনলীলার সেই স্থানটি কালক্রমে পরিণত হয়েছে তীর্থকেন্দ্রে। তার স্মৃতিধন্য তীর্থকেন্দ্রে ঢুকতেই বামদিকে শ্রী চৈতন্য মঞ্চ, ডানে মূল মন্দিরে প্রবেশের সিঁড়ি। সোজা ঢুকে গেলে মন্দির। শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে মহাপ্রভুর পিতামহ, মাতামহ, বাবা-মা, লীলাস্থানে চৈতন্য ও কৃষ্ণ এবং বৈষ্ণব ধর্মের পাঁচ প্রভু- শ্রী অদ্বৈত, শ্রী নিত্যানন্দ, শ্রী গৌরাঙ্গ, শ্রী গদাধর ও পণ্ডিত শ্রীবাস পণ্ডিতের প্রতিকৃতি। এরপর ভোগরান্নার ঘর, পিছনে ভক্ত-সেবায়েতদের থাকার জায়গা।
অরূপরতনের সন্ধানে শ্রীচৈতন্যের বাস্তুলীলায় গিয়ে জানা গেল, প্রধান সেবায়েত রাধা বিনোদ মিশ্র সফরে গেছেন। তার জায়গায় পূজা, ভোগসহ সবকিছুর দেখভাল করছেন বাবুই চক্রবর্তী। বড্ড ব্যস্ত তিনি। অপরাহ্নের পূজা হয়ে গেছে, কিন্তু ভোগ এখনও দেওয়া হয়নি, রান্না চলছে। নিজ হাতেই রান্না সামলাচ্ছেন তিনি।

নমস্কার জানাতেই বাবুই চক্রবর্তী বললেন, ‘আজ তো দাদা বড় ব্যস্ত। অন্য এক সময় আসেন, বসে কথা বলা যাবে’।

তবু হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে যা একটু বললেন, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, চৈতন্য মহাপ্রভু ঈশ্বরের তিনটি পৃথক পৃথক রূপের আধার। প্রথমত, তিনি কৃষ্ণের ভক্ত, দ্বিতীয়ত, তিনি কৃষ্ণভক্তির প্রবক্তা এবং তৃতীয়ত, তিনি রাধিকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ কৃষ্ণের স্বরূপ।

তার সেই রূপসাগরের সন্ধান পেতে ভক্তরা ভিড় জমিয়েছেন তার চরণতলে। কেউ প্রণাম-প্রার্থনা সেরে চলেছেন নিজ গন্তব্যে, কেউ ভোগ নিয়ে যাবেন। চারদিকে ভক্তিময় শান্তির পরিবেশ।

দুই বৈষ্ণবী পা ছড়িয়ে বসে। তাদের চোখে বুঝি অপার অন্বেষণ-
‘যদি গৌর না হইত তবে কি হইত
কেমনে ধরিতাম দে । ।
রাধার মহিমা প্রেম রস সীমা…’

১৪৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তখন ফাল্গুনি পূর্ণিমার সন্ধ্যা। চন্দ্রগ্রহণ চলছিল। নদীয়া জেলার নবদ্বীপের শ্রীধাম মায়াপুর নামক স্থানে আবির্ভূত হন কলিযুগের এ পাবনাবতার।
মাতার নাম শচীদেবী, পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র। কয়েকটি কন্যা সন্তানের পাশাপাশি জন্ম নেন দুই পুত্র সন্তান- শ্রী বিশ্বরূপ ও ও শ্রী বিশ্বম্ভর। এই বিশ্বম্ভরই নিমাই, চৈতন্য কিংবা গৌর বর্ণ বলে গৌরাঙ্গ। তাকে ভক্তরা ভালোবেসে ‘মহাপ্রভু’ বলেও সম্বোধন করেন।

মহাপ্রভু আটচল্লিশ বছর তার অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করেন। জীবনের প্রথম চব্বিশ বছর তিনি নবদ্বীপে শৈশব ও গার্হস্থ্যলীলা এবং পরবর্তী চব্বিশ বছর জগন্নাথ, পুরীসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কলিযুগের যুগধর্ম হরিনাম প্রচার ও কৃষ্ণভক্তি বিজ্ঞান শ্রীমদ্ভাগবত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সন্ন্যাসলীলা সম্পাদন করেন।

মহাপ্রভু কেবল শ্রীমদ্ভাগবতের বাণীই প্রচার করেননি, তিনি ভগবদ্গীতার মূল তত্ত্বও অত্যন্ত ব্যবহারিকভাবে শিক্ষাদান করেছেন।

‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থ বলছে, বিভিন্ন রাজ্যভ্রমণ শেষে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন তিনি। তখন বর্ণপ্রথায় জর্জরিত সমাজ। নিচু জাতদের জাতে তুলতে তিনি হাজির হলেন বর্ণ-গোত্রহীন এক মানবধর্ম নিয়ে।

অন্যদিকে, চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তার পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে বাংলার তৎকালীন শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) জেলার গোলাপগঞ্জের এ ( ঢাকা- দক্ষিণ বাজার) স্থানে এসে বসতি স্থাপন করেন। সেটি এখন পোড়োবাড়ি।

শ্রী চৈতন্য এখানেই এসেছিলেন ঠাকুমাকে দেখতে। লীলাচ্ছলে কীর্তন করতে করতে মিলিয়ে গেলেন বলে লোক বিশ্বাস, পরবর্তীতে তার ও কৃষ্ণের প্রতিকৃতির আদলকে ঘিরে গড়ে ওঠে মন্দির। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসতে শুরু করেন, পরিণত হয় ভক্তদের তীর্থস্থানে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬
এসএনএস/এএসআর

আরও পড়ুন...

*** জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে রেমা-কালেঙ্গা
*** রহস্যই থেকে গেলো যজ্ঞকুণ্ডের ধারা  
*** পিছুটান মুছে দেবে ভাড়াউড়া হ্রদ
*** লাউয়াছড়া গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া আসে
*** ‘সবাই বন্যপ্রাণী এনজয় করে কিন্তু তাদের কথা ভাবতে চায় না’
*** ওদের ট্রেন, মোদের ট্রেন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ