চা জাদুঘর (শ্রীমঙ্গল) থেকে: ছোট ছোট চারটি কক্ষ, দু’টি পাশাপাশি, দু’টি কয়েক গজ দূরে। তাতে একদিকে নির্যাতনের হাতিয়ার হাড়ের ছড়ি, অন্যদিকে শ্রমিকদের ব্যবহৃত নানান যন্ত্রপাতি।
টিলার ওপর ছড়িয়ে থাকা টিনশেড ঘরগুলোর মধ্যে প্রথমটিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো বঙ্গবন্ধুর আপাদমস্তক প্রতিকৃতি। খালি চেয়ার-টেবিলের পেছনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত বঙ্গবন্ধু ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন।
বিশাল ছবিটা দেখে মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন (১৯৫৭-৫৮)। তখন এসেছিলেন শ্রীমঙ্গল নন্দবানী চা বাগানে।
সে সময় তিনি যে চেয়ারে বসে মিটিং করেছিলেন সেই চেয়ার এটি। টেবিলও সেই মিটিংয়ের। আর সেই টেবিল-চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে এখনও যেন সব কিছু অবলোকন করছেন বঙ্গবন্ধু।
টেবিলে রাখা হয়েছে পরিদর্শন বই। তাতে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুর চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের তথ্য জেনে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে চা জাদুঘর পরিদর্শন করেন শ্রীমঙ্গলের ছেলে উত্তম দেবনাথ।
তিনি লিখেছেন, অবাক লাগলো, আমি শ্রীমঙ্গলে থেকে জানতাম না বঙ্গবন্ধু যে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। খুব ভালো লাগলো জেনে।
২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গল শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে (শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ রোডে) চা মিউজিয়ামের উদ্বোধন করা হয়। চা সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিত্যক্ত ভবনে ছোট্ট চারটি কুঠুরিতে চালু করা হয় এই মিউজিয়ামটি।
১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে চা শিল্পের বিকাশ শুরু। চা জাদুঘরটির পরিসর ক্ষুদ্র হলেও বাংলাদেশের একশ’ ছাপ্পান্ন বছরের চা শিল্পের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের ব্যবহৃত খুন্তি, কোদাল, চয়ন যন্ত্র, কাটার, কোদাল, ত্রি-ফলা টাইপের কোদাল, মহিলা শ্রমিকদের ব্যবহৃত মাদুলী, নুপুর, ঝুমকা, নানা ধরনের রুপার গহনা ইত্যাদি এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। স্থান পেয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ব্যবহৃত রৌপ্য তাম্র মুদ্রা।
হাড়ের ছড়ি যেন কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এখানে। এই ছড়ি দিয়ে শ্রমিকদের গণনা করা হতো, আর ভীতি তৈরির জন্য অহেতুক পেটানো হতো তাদের। রয়েছে কর্তাদের ব্যবহৃত লোহার পাপসও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হয় একটি যুদ্ধবিমান। সেই যুদ্ধবিমানের অংশ বিশেষও স্থান করে নিয়ে জাদুঘরটিতে। কাঠ দীর্ঘদিন মাটির নিচে থেকে পাথরে রূপান্তরিত চার খণ্ড জীবাশ্ম ঠাঁই করে নিয়েছে কাচের ফ্রেমে।
রয়েছে নেপচুন চা বাগান থেকে সংগৃহীত কেরোসিনের কুপি দিয়ে চালিত ‘মাঝারি ফ্রিজ’, মাথিউড়া চা বাগান থেকে প্রাপ্ত হাতে ঘোরানো টেলিফোন সেটও। আরও রয়েছে ব্রিটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, সার্ভে চেইন, হস্তচালিত নলকূপ, লিফট পাম্প, সিরামিকের পানির ফিল্টার, সিরামিক জার, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, পুরনো রেডিও টেলিফোন সেট, প্রুনিং দা, টাইপ রাইটার, প্রাচীন পিএইচ মিটার ও চা প্রসেসিং যন্ত্রপাতি।
রফিকুল ইসলাম নামের এক দর্শনার্থী বলেন, চা জাদুঘর দেখতে কেমন, সেই কৌতূহল থেকেই এখানে এসেছি। একদিন এসে ফিরে গেছি। এটি শুধু টি-রিসোর্টে অবস্থানকারীদের দেখার জন্য। তবে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখার অনুমতি নিয়ে দেখলাম। খুবই ভালো লেগেছে। তবে কুঠুরি থেকে বের করে আনা উচিত জাদুঘরটি।
বাংলাদেশ টি বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে জাদুঘরটি। চা গবেষণা কেন্দ্রের কাছে ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু চা বাগান ঘেরা জাদুঘরটি অনেকের আগ্রহের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। দৈন্য সেখানে স্পষ্টই ফুটে উঠলেও আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. মাঈনুদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা স্বল্প পরিসরে কাজটি শুরু করেছি। ভবিষ্যতে এর প্রসারের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা আশা করছি অন্যান্য জাদুঘরের মতো এই জাদুঘরও একদিন জনপ্রিয় হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৬
এসআই/এইচএ/
*** গরুও মানিয়ে নিয়েছে হাওরকে
*** ‘শ্রীমঙ্গল কিন্তু এক্কেবারে অন্য ধাঁচের’
*** মুভি দেখে পুলিশে যোগদান
*** ভোরের স্নিগ্ধ লাউয়াছড়া-১
*** লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা
*** হ-য-ব-র-ল বগিতে ভোগান্তির পারাবত!